পাকিস্তানের বন্যা দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ হুমকি তুলে ধরছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানে সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ বন্যা পুরো বিশ্বের জন্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সতর্কবার্তা।
শুধু দরিদ্র দেশ নয়, রেকর্ডভাঙ্গা বৃষ্টিপাতে যেকোনো দেশ বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে–বিবিসির কাছে এমন মন্তব্য করেছেন একজন জলবায়ু বিজ্ঞানী।
এমন বন্যায় মানবিক বিপর্যয় ধারণাতীত হয়ে ওঠে, যেমন দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানে। স্রোতে ভেসে গেছে দেশটির প্রায় অর্ধেক জমির ফসল। দেশটির মন্ত্রীরা এখন চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন।
জলবায়ু বিপর্যয়ের অন্যায্য ভুক্তভোগী হওয়ায় ক্ষুদ্ধ পাকিস্তানীরা। দেশটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্র ১ শতাংশের কম করেও, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।
পাকিস্তানের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শেরি রহমান বলেছেন, 'দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে গেছে। আগের প্রতিটি বন্যার সীমা ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, যা আর কখনই দেখা যায়নি'।
শেরি রহমান এতটুকুও বাড়িয়ে বলেননি। পাকিস্তানের ভৌগলিক অবস্থানও এজন্য দায়ী। দেশটি বিশ্বের এমন অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে দুইটি প্রধান জলবায়ু ব্যবস্থা কাজ করে। এর একটি বছরের বেশিরভাগ সময় উচ্চ তাপমাত্রা ও খরার মতো শুস্ক আবহাওয়া নিয়ে আসে, যেমন গত মার্চে দেখা দেয়া তাপপ্রবাহ। অন্যটি সৃষ্টি করে, মৌসুমি বৃষ্টি বা বর্ষাকাল।
পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ সুপেয় পানি ও উর্বর মাটির সুবিধা নিতে ঐতিহাসিকভাবেই সিন্ধু নদীর দুই পাড়ে বসতি গড়ে থাকে। বর্ষাকালে সিন্ধু নদ উপচে পড়লে অনেক সময় বন্যা দেখা দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সরাসরি সম্পর্ক আছে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের। পৃথিবী যত উষ্ণ হচ্ছে, ততই বাড়ছে বায়ু ও সাগরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। তাতে পানির বাষ্পীভবন বেড়েছে বহুগুণ। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জলীয় বাষ্প শীতল হলে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে, অর্থাৎ তা দীর্ঘসময় জমে থাকে না। কিন্তু, উষ্ণ বাতাস আরও বেশিদিন জলীয় কণা ধরে রাখতে পারে। তাই যখন বর্ষা আসে, তখন বিপুল মেঘের রাশি একসাথে ভেঙে পড়ে কোনো অভাগা অঞ্চলের ওপর।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষাকালে গড় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে। জার্মান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের বিজ্ঞানী আনজা কাৎজেনবার্জার এই ব্যাখ্যা দেন।
ইতোমধ্যেই বর্ষার তাণ্ডব দেখা গেছে, উত্তরপূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ এবং তারপর সম্প্রতি পাকিস্তানে।
পাকিস্তানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আরেকটি বড় কারণ, হিমবাহের নজিরবিহীন গলন। মেরু অঞ্চলগুলির বাইরে পাকিস্তানের উত্তরাচঞ্চলে রয়েছে সবচেয়ে বেশি হিমবাহের বরফ। একারণে অঞ্চলটিকে 'তৃতীয় মেরু'-ও বলা হয়।
হিমবাহগুলি গলতে শুরু করেছে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে। বিশেষত, গিলগিট-বালটিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলের হিমবাহ উদ্বেগজনকভাবে গলে তৈরি করেছে ৩ হাজারের বেশি হ্রদ। বিবিসিকে এ তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।
সংস্থাটির মতে, এরমধ্যে ৩৩টি হ্রদের পাড় পানির চাপে আকস্মিকভাবে ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর তা হলে, লাখ লাখ ঘনমিটার জলরাশি, পাথর ও পলি ধেয়ে আসবে ভাটির দিকে; তাতে বিপন্ন হতে পারে ৭০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা।
আকস্মিক এই ঢলের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আগাম সতর্কবার্তা দেয়ার ব্যবস্থা এবং সুরক্ষিত অবকাঠামো তৈরির কাজ করছে পাকিস্তান সরকার ও জাতিসংঘ। তবে পাকিস্তানের দরিদ্র এলাকায় কাজটি পাহাড় প্রমাণ চ্যালেঞ্জের। কারণ এখানকার বেশিরভাগ অবকাঠামোই দুর্বল।
অতীতেও দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনান্য অঞ্চলে দুর্বল অবকাঠামো বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নজির রয়েছে। তার সাথে অতি-বৃষ্টির চাপও সহ্য করতে পারে না মাটির বাড়িঘর। মাটির বাড়ি ধসে এবারের বন্যায় পাকিস্তানে বহু মানুষ হতাহতও হয়েছে।
অবকাঠামো শক্তিশালী হলেই অবশ্য প্রকৃতির বিরূপ আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না–এমনটা জানান জলবায়ু অভিঘাত বিষয়ক বিজ্ঞানী ফাহাদ সাঈদ। তার মতে, ধনী দেশগুলোও মারাত্মক বন্যার কবলে পড়তে পারে, তাতে হিমশিম খাবে তাদের দুর্যোগ মোকাবিলার ব্যবস্থা।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'এ ধরনের বন্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এবং জান্তব শক্তি নিয়ে আঘাত হানে। যেমন এবছর পাকিস্তানে নজিরবিহীন বৃষ্টি হয়েছে, বানের পানির উচ্চতাও অনেক বেশি। এ ধরনের বন্যা শক্তিশালী অবকাঠামো থাকা দেশকেও পরিস্থিতি সামাল দিতে দুর্গতির মধ্যে ফেলবে'।
ফাহাদ ২০২১ সালে জার্মানি ও বেলজিয়ামে দেখা দেয়া আকস্মিক বন্যার দৃষ্টান্তও উল্লেখ করেন।
চলতি বছরের জুন থেকে আগস্ট সময়ে ৩০ বছরের গড়ের চেয়ে ১৯০ শতাংশ অতিরিক্ত বা ৩৯০.৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে পাকিস্তানে।
ফাহাদ জানান, দেশটির আবহাওয়া বিভাগও জনগণকে ধেয়ে আসা ভয়াল বন্যার বিষয়ে আগাম সতর্ক করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানের সীমিত বন্যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা দরকার বলেও মনে করছেন তিনি।
এই বিজ্ঞানী বলেন, পুরো পৃথিবীতে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল যেসব দেশের মানুষের কার্বন ফুটপ্রিন্ট সবচেয়ে কম– তারাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে।
'পাকিস্তানের ভয়াল বন্যার শিকার বেশিরভাগ মানুষ থাকে মাটির তৈরি বাড়িতে, তাদের অন্যান্য সম্পদও সীমিত। বলতে গেলে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তাদের কোনো দোষ নেই'- যোগ করেন তিনি।
- সূত্র: বিবিসি