রিলায়েন্সের ভবিষ্যৎ কর্ণধার: আম্বানির পরিকল্পনার সম্মুখভাগে মেয়েরাই
অবশেষে জানা গেল ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানির বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের কর্ণধার কে হতে চলেছেন। গত আগস্ট মাসের শেষদিকে এক বার্ষিক সাধারণ সভায় তিন সন্তানের কে কী পাচ্ছেন তার পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছেন আম্বানি।
আম্বানির 'উত্তরসূরী পরিকল্পনা' হলো ভারতের কর্পোরেট জগতের সবচেয়ে 'অনুমিত নেতৃত্ব হস্তান্তর'। রিটেইল থেকে রিফাইন- আম্বানির ব্যবসার বর্তমান মোট মূল্য ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আম্বানির প্রথম সন্তান আকাশ আম্বানি পাচ্ছেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর টেলিকমিউনিকেশন ব্যবসার দায়িত্ব। রিটেইল ব্যবসার দায়িত্ব পাবেন আকাশের জমজ বোন ইশা আম্বানি। আর ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানি নিউ এনার্জির দেখভাল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এখনও আম্বানির 'উত্তরসূরী পরিকল্পনা'র এর চেয়ে বেশি বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে তিনি যে অতীতের পুনরাবৃত্তি করতে চাচ্ছেন না সেটা বেশ স্পষ্ট।
বিশ বছর আগে তার বাবা সম্পত্তি উইল করে যাওয়ার আগেই মারা গেলে ছোট ভাইয়ের সাথে উত্তরাধিকার নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ এক লড়াই বেঁধে যায় আম্বানির।
মেয়ে ইশা আম্বানির আগ পর্যন্ত আম্বানিদের ব্যবসায়ে কোনো নারীকে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়নি।
গত দুই দশক যাবৎ ভারতে কতিপয় বিশিষ্ট শিল্পপতি পরিবারে প্রজন্মের পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পরিবারের নারীরাও ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাচ্ছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে তাদেরকে।
অগ্রিম প্রস্তুতি
আম্বানির বয়স এখন ৬৫। রিলায়েন্সের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কোম্পানির গুরুদায়িত্বগুলো সক্রিয়ভাবে সামলান তিনি। চাইলেই সন্তানদের আরও পরে লাইমলাইটে আনতে পারতেন তিনি।
কিন্তু যেখানে এশিয়ার অন্যান্য পিতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলোতে পুরুষ পরিবারপ্রধান শেষ পর্যন্ত সম্পদের মালিকানা ধরে রাখেন, আম্বানি সেখানে এশিয়ায় 'পারিবারিক ব্যবসায়ের নতুন প্রজন্মের' প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি নিজে উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই সন্তানদের জন্য এ পথটি মসৃণ করতে চান আম্বানি।
টাটা গ্রুপ থেকে শুরু করে সিংঘানিয়া পরিবার: ভারতের এ বিখ্যাত পারিবারিক কোম্পানিগুলোতে উত্তরাধিকার নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ দ্বন্দ্বের ইতিহাস রয়েছে। এসব দ্বন্দ্ব আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, যার ফল ভোগ করতে হয়েছে কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডারদেরকে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, আম্বানিদের মতো বিত্তবান এশীয় পরিবারগুলো ন্যাড়ার মতোই একবারই বেলতলায় যায়।
ওয়েলথ কন্সাল্টিং ফার্ম 'হাবিস'-এর মতে কোভিড-১৯-এর সময়ে এসে প্রজন্মের মধ্যকার সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যাপারটি আরও গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গ্লোবাল প্রপার্টি কনসাল্টেন্সি নাইট ফ্র্যাংক-এর তথ্যমতে, এশিয়ার বিলিয়নারদের মধ্যে অর্ধেকেরও কম পরিবারের উত্তরাধিকার পরিকল্পনা প্রস্তুত আছে। করোনা মহামারি এই টাকার কুমিরদের ৮৪ শতাংশকে তাদের সম্পত্তি হস্তান্তরের পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে প্রণোদিত করেছে।
নেতৃত্বে জেন্ডারভিত্তিক পরিবর্তন
উত্তরাধিকার পরিকল্পনায় পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে নারীদের ভূমিকাও।
আম্বানি তার তিন সন্তান সম্পর্কে এক বক্তব্যে বলেন, নেতৃত্বদানকারী এই নবীন দলের সবাই সমানভাবে ইতোমধ্যে রিলায়েন্সে পেশাদারিত্বের সাথে চমৎকার কাজ করছেন।
ইশা আম্বানি পারিবারিক ব্যবসায়ে যেভাবে 'সমান' গুরুত্ব পাচ্ছেন, তার আগে পরিবারটির অন্য নারী সদস্যরা তা পাননি। আম্বানি পরিবারের উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদের আগেই তার খালাদের আরেকটি ব্যবসায়িক পরিবারে বিয়ে হয়ে যায়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ইশা আম্বানিকে রিলায়েন্স সাম্রাজ্যে যুক্ত করার জন্যই প্রস্তুত করা হয়েছে। এই আম্বানি-কন্যা আগে কনসাল্টিং জায়ান্ট ম্যাকিঞ্জি'তে কাজ করেছেন।
আম্বানি পরিবার ভারতের গুজরাটি বণিক পরিবার। মুকেশ আম্বানির মতো প্রভাবশালী ব্যক্তির উত্তরাধিকারে জেন্ডারভিত্তিক এ পরিবর্তন অন্যান্য গতানুগতিক পরিবারগুলোতে একটি 'শক্তিশালী বার্তা' প্রেরণ করে- এমনটা মনে করেন ইন্ডিয়ান স্কুল অভ বিজনেস-এর অধ্যাপক কাবিল রামচন্দ্রন।
লিগ্যাসি প্ল্যানিং ফার্ম টেরেন্টিয়া'র প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক সন্দীপ নেরলেকার বলেন, 'আম্বানির এই পদক্ষেপ অন্যান্য ব্যবসায়িক পরিবারগুলোতে বড়সড় প্রভাব ফেলবে।'
জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের ভূমিকা পাওয়া বড় বড় ব্যবসায়িক পরিবারগুলোর নারী সদস্যের নতুন প্রজন্মের একজন ইশা আম্বানি। এই দলে আছেন গোড্রেজ কনজিউমার প্রোডাক্টসের নির্বাহী পরিচালক নিসাবা গোড্রেজ, পার্লে অ্যাগ্রোর প্রধান নাদিয়া চৌহানসহ আরও অনেকে।
জেন্ডারভিত্তিক এই পরিবর্তনের পেছনে অনেক প্রভাবক আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাদের মতে, নারী সদস্যদের উচ্চশিক্ষা, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠন এর মধ্যে অন্যতম।
ভারতের সবচেয়ে বড় টেক্সটটাইল কোম্পানিগুলর একটি ওয়েলসপান ঈন্ডিয়া'র প্রধান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীপালি গোয়েনকা ১৮ বছর বয়সে বিয়ের পর তার স্বামীর ব্যবসায়ে যুক্ত হন। তার সন্তানেরা বড় হবার পর তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়তে যান।
তার মতে, 'নারীরা এখন তাদের অধিকার এবং সক্ষমতা নিয়ে আরও বেশি সরব। কিন্তু এখনও অনেক পথ বাকি।'
একটি গবেষণার বরাত দিয়ে নেরলেকার বলেন, 'ভারতে প্রতি দশের মধ্যে আট পরিবারের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ছেলেদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আছে। এমনকি এখনও ছেলে ও মেয়ে সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ সমান নয়।'
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের মতো আইনি পরিবর্তনগুলো নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে প্রশস্ত করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া ভারত সরকারের আইন অনুযায়ী নারীদেরকে কোম্পানির বোর্ডে সংযুক্ত করার বাধ্যবাধকতাও নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে একটি লড়াই- আর এটার সূচনাই হয়েছে কেবল।
সূত্র: বিবিসি