লটারি জেতাই যখন প্রায় কাল হয়ে দাঁড়াল এক ট্যাক্সিচালকের জন্য
মানব জীবন বড়ই অনিশ্চিত। কখন কী ঘটে তার নিশ্চয়তা নেই। এই যেমন ভারতের অনুপ নামের এক ট্যাক্সিচালক লটারি জিতে রীতিমত অসংখ্য খবরের শিরোনাম হয়েছেন, অথচ এর আগে স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাইরে তাকে কেউই চিনত না।
স্বভাবতই ধরে নেওয়া যায় লটারি জেতা ব্যক্তির জীবনে আসবে স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বচ্ছলতা। কিন্তু ঠিক উল্টোটা ঘটেছে অনুপের বেলায়। অনেক ঝামেলা পোহানোয় শ্রান্ত হয়ে লটারি জিতে অনুশোচনা করতেও বাধ্য হয়েছেন তিনি। খবর বিবিসির।
ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালার বাসিন্দা অনুপ। সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখে একটি সরকারি লটারি জিতে তিনি পেয়ে যান ২৫ কোটি রুপি, যা আজ পর্যন্ত সরকারি লটারিতে দেওয়া সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ।
লটারি জেতার দুই মাসের মাথায় তার জীবনে এমন পরিবর্তন এসেছে যা তিনি কখনো কল্পনা করতে পারেননি। রীতিমত তারকা বনে গেছেন তো বটে, আবার হিংসার রোষানলেও পড়তে হচ্ছে তাকে।
বাড়ির বাইরে বেরোলেই যেন সবাই তাকে চেনেন। বহু সংবাদপত্রের শিরোনামে ছাপা হয়েছে তার নাম। টেলিভিশনের পর্দায় পরিচিতমুখ হয়ে উঠেছেন ৩২ বছর বয়সী অনুপ। এক কথায় ভাইরাল হয়ে যান তিনি।
জেতার এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই আবার ভাইরাল হয়ে যান তিনি। এবার ভাইরাল হন তার একটি ভিডিওর জন্য। সেখানে দেখা যায় অর্থের জন্য তিনি তাকে এবং তার পরিবারকে হয়রানি না করতে অনুরোধ করছেন। ভিডিওটির এক পর্যায়ে তিনি লটারি জেতার অনুশোচনাও করেন।
সাক্ষাৎ মাত্রই প্রায় পরিচিত সবাই তার কাছে টাকা চেয়ে বসেন। এবং অনেক বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজন এখন তার ওপর নারাজ।
তিনি জানান, 'একসময় যাদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল তাদের অনেকেই এখন আমাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন।'
'যারা এরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন কেবল তারাই এটির মর্ম বুঝবেন। এ যেন কোনো মুভির দৃশ্য। পরিচিত সবাই হঠাৎ আপনার বাড়িতে এসে হাজির,' সংযোজন করেন তিনি।
প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি লটারি কিনছেন। এর আগে ছোট পরিমাণ অর্থও জিতেছেন তিনি। কিন্তু অবশেষে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জেতাই যেন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিজয়ী ঘোষণার এক সপ্তাহ পরেই তার বাড়ি সাহায্য প্রার্থীদের দ্বারা ভরে যায়। সেসময়ের কথা মনে করে তিনি বলেন, 'প্রতিদিন সকালে উঠে দেখতাম বাইরে ভিড় লেগে আছে। সকাল পাঁচটা থেকে তারা রাত পর্যন্ত সেখানেই থাকতেন।'
অনুপের স্ত্রী মায়া এক স্থানীয় সংবাদ চ্যানেলকে জানান, টাকা পাওয়ার পর তারা মানুষদের সাহায্য করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনাও করেছিলেন।
মায়া বলেন, 'রাজ্যের বাইরে থেকেও সাহায্যের অনুরোধ আসতে থাকে। কেউ তাদের ঋণ বা মর্টগেজ পরিশোধের জন্য সাহায্য চায়, আবার কেউ কেউ তাদের মেয়েদের বিয়ের খরচ মেটাতে অনুরোধ করে।'
কেবল এসব কারণেই আর্থিক সাহায্যের অনুরোধ আসেনি। চলচ্চিত্র তৈরির জন্য অর্থ প্রদানেরও অনুরোধ এসেছে তার কাছে।
অনুপ বলেন, 'ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানি থেকে অনেক কল আসে। এক ফিল্মের জন্য ফান্ডের অনুরোধ করতে চেন্নাই থেকেও একটি দল এসেছিল আমার কাছে।'
অনুপ বলেন, 'মানুষের আপনার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি রাতারাতি বদলে যাবে। আমি আমার ছেলের জন্য একটা দোকানে ব্যাগ কিনতে যাই। মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে তারা আমাকে বাকি টাকাটা আর ফেরত দেয়নি। তাদের ধারণা আমার ওটা লাগবে না', বলেন তিনি।
এমন অহরহ পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় তাকে। আবার অনেকে বিনা পরিশ্রমে অনুপ এই টাকা পেয়েছেন বলে মনে করেন তারাও এই অর্থের ভাগীদার এবং ফলে চেয়ে বসছেন যাচ্ছেতাই!
'একজন ব্যক্তি আমাদের বাড়িতে সারাদিন ছিলেন একটাই দাবি নিয়ে; তাকে একটি রয়াল এনফিল্ড মোটরবাইক কিনে দিতে হবে', বলেন অনুপ।
অনলাইনে প্রচলিত গুজবও তাদের শান্তি নষ্টের কারণ। অনুপ জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লটারি জেতেননি এবং এর আগেও তার অনেক অর্থ ছিল-এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
এত ধকলের পরে এখন বাইরে বেরোতেও ভয় পান অনুপ। এছাড়াও চিন্তিত থাকেন তার ছেলে সন্তান এবং আট মাসের গর্ভবতী স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে।
তবে লটারি জিতে শুধু তার ভাগ্যেই এমন দশা জোটেনি, এমনটা জেনে তিনি কিছুটা স্বস্তি পান। অক্টোবর মাসে একটি গেইম শোতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে এক স্থানীয় টিভি চ্যানেলে জয়পালান নামে ৫৯ বছর বয়সী এক ব্যক্তির সাথে তার দেখা হয়। জয়পালান গত বছর একই লটারিতে বিজয়ী হয়ে ১২ কোটি রুপি পেয়েছিলেন এবং তাকেও অনুপের মতো মিডিয়ার মনোযোগ ও অর্থের অনুরোধের ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'কার প্রকৃতপক্ষেই সাহায্য প্রয়োজন আর কে কোনো প্রয়োজন ছাড়াই টাকা চায়- তা বলা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। বন্ধুরা হয়ে যায় শত্রু; টাকা দিইনি বলে অনেকে এখনো আমার ওপর নারাজ।'
কিছু হুমকিমূলক চিঠি আসার কারণে পুলিশের কাছে অভিযোগও দায়ের করতে হয়েছিল তাকে। এছাড়াও নিরাপত্তার জন্য বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি অনুপকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
অনুপ বলেন, 'মানুষ মনে করে লটারি জিতে আমার টাকা নিয়ে সব দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। কিন্তু এখনো সবকিছু অনিশ্চিত। কর পরিশোধের পর জানিনা লটারির কত অংশ আমার হাতে থাকবে।'
করসহ সবকিছু পরিশোধের পর ঠিক কত টাকা বিজয়ীর হাতে আসে তার হিসাবটা বেশ জটিল। রাজ্য সরকারকে প্রদেয় ৩০ শতাংশ কর বাদেও লটারি টিকেট প্রতিনিধিরা কিছু কমিশন কেটে রাখেন। এছাড়া ফেডারাল সরকারকে উপকর এবং সারচার্জ পরিশোধ করতে হয় বিজয়ীর।
অনুপের লটারি জেতায় সৃষ্ট হট্টগোলের পর রাজ্য সরকার সঠিক উপায়ে অর্থ ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করতে তার জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর একদিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে।
জেতা অর্থ কীভাবে কাজে লাগানো যাবে তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কয়েক বছর অপেক্ষা করার পরিকল্পনা রয়েছে অনুপের।
তিনি বলেন, 'টাকাটা যে একটা আশীর্বাদ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো কিছু করা বা কাউকে সাহায্য করার আগে, আমার এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে যাতে করে আমার পরিবারের সঠিক যত্ন নেওয়া হয় এবং তাদের ভবিষ্যত যেন নিশ্চিত হয়।'