ভারতে বাড়ছে মাতৃদুগ্ধের বিক্রি, এটা ডেইরি পণ্য নাকি আয়ুর্বেদ ওষুধ?
পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ১৫ মিলিলিটারের খুব ছোট বোতলে, যা একটি আইড্রপ ওষুধের কৌটোর সমান। আবার কখনোবা পাড়ার দোকানগুলোতে শ্যাম্পুর যে মিনি প্যাকেট পাওয়া যায়- সেভাবে প্যাকেটজাত করে। ফলে ফ্রিজে রাখার ঝামেলা ছাড়াই অনায়সে এসব মোড়ক বা বোতল কিনে নবজাত শিশুকে দুধ খাওয়ানো যাবে। এখন যদি শোনেন- এই পণ্য আসলে মানব স্তনের দুধ! চোখ বিস্ময়ে কপালে উঠলো কী?
পুরো ঘটনার কোনোটাই কাল্পনিক নয়, বরং প্রতিবেশী ভারতের চাইল্ডকেয়ার পণ্যের বাজারে এভাবেই যুক্ত হয়েছে নতুন পণ্যটি।
এটি বাজারজাত করছে নতুন দুটি প্রতিষ্ঠান। তাদের এই নজিরবিহীন পণ্যের বিক্রিবাট্টাও ক্রমে বাড়ছে। অথচ এনিয়ে নেই আইনের স্পষ্টতা বা এ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের কোনো বিধিমালা। মাতৃদুগ্ধ বিক্রির সাথে জড়িত নৈতিক যেসব প্রশ্ন সঙ্গতকারণেই উঠতে পারে সেগুলোও তারা এড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে আপাতত।
বেসরকারি কোম্পানি দুটি হলো– বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক নিওল্যাক্টা লাইফসায়েন্স প্রাইভেট লিমিটেড এবং মোহালি-ভিত্তিক নেসলাক বায়োসায়েন্সেস প্রাইভেট লিমিটেড। প্যাটেন্টকৃত প্রযুক্তির আওতায় তারা মাতৃদুগ্ধ বিক্রি ব্যবসা করছে, যেখাতে নেই ভারত সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রক বিধিমালা।
এরমধ্যে নিওল্যাক্টা লাইফসায়েন্স ২০১৬ সালে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। কোম্পানিটির দাবি, স্তন্যদানকারী মায়েদের স্বেচ্ছায় দান করা দুধ তারা সংগ্রহ করে। এরপর তা পাস্তুরিত করে উচ্চ দামে নবজাতক সন্তানের বাবা-মার কাছে বিক্রি করে। এই কোম্পানিটি বিশ্বে প্রথমবারের মতো মানবদুগ্ধের ফর্টিফায়ারও পাউডার হিসেবে বিক্রি করছে।
অপরদিকে, নেসল্যাক বায়োসায়েন্সেস যাত্রা শুরু করে ২০২১ সালে। কোম্পানিটি মাতৃদুগ্ধ পাউডার করে বিক্রি করে অতি উচ্চ দামে। কোম্পানির দাবি, তাদের কাছে এ ধরনের দুধের মান পরীক্ষার জন্য দরকারি প্রযুক্তি আছে। এমনকী হাসপাতালগুলোতে ডোনার মিল্ক ব্যাংক স্থাপনেও সহায়তা দেয় তারা।
উভয় কোম্পানির-ই দাবি, মাতৃদুগ্ধের গুণাগুণ রক্ষা করেই তারা এটি বাজারজাত করছে। আর যেসব শিশু অপরিণত 'প্রিটার্ম' অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, তাদের দুধের পুষ্টি চাহিদা মেটাচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞামতে, যেসব শিশু ৩৭ সপ্তাহ (২৫৯) দিন গর্ভে থাকার পর ভূমিষ্ঠ হয় তাদের 'প্রিটার্ম বেবি' বলা হয়। অনেক সময় এই শিশুদের মায়ের স্তনে দুধ তৈরি হয় না।
তবে তাদের এই অভিনব ব্যবসার মডেল একাডেমিক, জনস্বাস্থ্য অধিকার কর্মী এবং দেরিতে হলেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে এসেছে।
জনস্বাস্থ্য অধিকার কর্মীরা এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তুলেছেন এই বাণিজ্যের পেছনের নৈতিক দিক নিয়েও প্রশ্ন। তাদের মতে, এর মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র মায়েরা শহরের সম্পন্ন পরিবারের জন্য তাদের দুধ বিক্রি করছে, যেটা তাদের সন্তানের প্রাপ্য।
চিকিৎসকদের একটি গ্রুপ বলেছে, এই কোম্পানিগুলো মানবদুগ্ধ বিক্রির প্রচারণা চালায়, অথচ তাদের এই ফর্মুলা স্পষ্টতই ইনফ্যান্ট মিল্ক সাবস্টিটিউটস অ্যাক্ট আইনের অধীনে পড়ে।
তবে কোন পণ্য মানবদুগ্ধজাত তা নির্ধারণ এবং এটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার– এসব বিষয়ে কোনো ঐক্যমত্য নেই সরকারি বিভাগগুলোর মধ্যে। এসব বিষয় অমীমাংসিত থাকা সত্ত্বেও দুটি কোম্পানিই ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও মান কর্তৃপক্ষ (এফএসএসএআই)- থেকে নিবন্ধন পায়। তবে চলতি বছরের এপ্রিলে নিওল্যাক্টার এবং সেপ্টেম্বরে নেসল্যাকের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
নিওল্যাক্টা ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের আয়ুর্বেদ বিভাগ থেকে 'আয়ুর্বেদ ওষুধ' হিসেবে তাদের পণ্য বিক্রির লাইসেন্সও নেয়। এরপর সেপ্টেম্বরে সেটি বাতিলের জন্য হস্তক্ষেপ করে ভারতের আয়ুর্বেদ মন্ত্রণালয়। টাইমস অভ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এবিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টকে নিওল্যাক্টা কর্তৃপক্ষ জানান, বৈশ্বিকভাবে চর্চিত সর্বোচ্চ নৈতিক মানদণ্ড রক্ষা করে তারা ব্যবসা পরিচালনা করেন। অন্যদিকে, নেসল্যাক কর্তৃপক্ষের সাথে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের মন্তব্য জানতে ব্যর্থ হয় গণমাধ্যমটি।
কোম্পানি দুটি অবশ্য মানবদুগ্ধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিক্রি নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যেই লাইসেন্স বাতিলের বিরুদ্ধে গত সেপেম্বরে কর্ণাটকের হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে নিওল্যাক্টা।
তবে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী মানবদুগ্ধ বাণিজ্যিকীকরণের বিপক্ষে। এই বিষয়ে তারাও আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও মান কর্তৃপক্ষ (এফএসএসএআই)-ও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে।
আপাতত হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ পেয়ে বোতল ও মোড়কে দুধের বাজারজাত চালু রাখতে পেরেছে নিওল্যাক্টা। ভারতের কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যেও কোম্পানিটি সচল থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।