ইউক্রেনে ট্যাংক অপচয়, সময়ও নষ্ট
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ন্যাটোর কাছে ট্যাংক চাওয়ার অনুরোধের পর অবশেষে ইউক্রেনের কাছে অত্যাধুনিক মেইন ব্যাটল ট্যাংক (এমবিটি) হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের মিত্ররা।
রুশরা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর পূর্ব ইউক্রেন এবং ক্রিমিয়ার মধ্যে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার এই মুহূর্তে পশ্চিমারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রুশরা পিছিয়ে যাওয়ার পর, ইউক্রেনীয়রা কিয়েভের যুদ্ধে তাদের জয়কে কাজে লাগিয়ে রুশদের সাথে বৈঠকে বসার সুযোগকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পূর্ব ইউক্রেনে ঘাঁটি গেঁড়ে বসা রুশদের ওপর প্রতি-আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়।
নিজেদের অঞ্চলেই রক্ষণাত্মক অবস্থা থেকে আক্রমণাত্মক দিকে সরে আসার পর ইউক্রেনের যে অঞ্চল রুশরা ২০১৪ সাল থেকে দখলে রেখেছে, সেখানকার ইউক্রেনীয়দের অবস্থাও পরিবর্তন হয়েছে।
রাশিয়া এখন পূর্ব ইউক্রেনে ৩ লক্ষ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে, যাদেরকে নিয়ে যেকোনো মুহূর্তে পুনরায় আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। রাশিয়ার এই প্রতিক্রিয়া দেখে ন্যাটো মিত্ররাও একেবারে শেষমুহূর্তে ইউক্রেনকে সাহায্যের জন্য নিজেদের হাতে থাকা বিভিন্ন ধরনের ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেকেই নিজেদের যুক্তিবোধকে বাদ দিয়ে এটি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু যখন কেউ এই ট্যাংক পাঠানোর সময় নিয়ে চিন্তা করবে, বিশেষ করে যখন রাশিয়ার পূর্ণশক্তির আক্রমণ না সত্ত্বেও ইউক্রেনের রক্ষণব্যূহ ভেঙে পড়ছে, তখন ন্যাটোর এই সিদ্ধান্ত যে ভুল, বিপদজনক, এমনকি নিরর্থকও, তা সহজেই অনুমেয়।
এগুলো ইউক্রেনকে তেমন সাহায্য করবে না, বরং এর ফলে আরও ইউক্রেনীয় যুদ্ধে মারা যাবে, এবং রাশিয়ার সাথে আরও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে পশ্চিমাদেরকে।
ন্যাটো কয়টি ট্যাংক পাঠাচ্ছে?
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রিটেন ১৪ থেকে ১৫টি চ্যালেঞ্জার টু-এর একটি কোম্পানি পাঠাবে। অনেকদিন ধরে না পাঠাতে চাইলেও জার্মানিও তাদের লেপার্ড টু ট্যাংক পাঠানোর সম্মতি দিয়েছে। তবে এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রকেও তাদের এম১ আব্রামস ট্যাংক পাঠাতে হবে এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছে জার্মানি।
সবমিলিয়ে, জার্মানরা লেপার্ড ট্যাংকের একটি কোম্পানি (১৪-১৫টি) পাঠাবে, অন্যদিকে মার্কিনরা ৩১টি এম১ আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর সম্মতি দিয়েছে।
তবে কোনো পশ্চিমা দেশই ভাবছে না যে কয়েক মাসে আগে ইউক্রেন তাদের যুদ্ধজয়ের জন্য ৩০০টি ট্যাংক চেয়েছিল।
অন্যদিকে, সাড়ে তিন লক্ষ সৈন্যের পাশাপাশি রাশিয়া প্রায় ২০০টি টি-৯০ ট্যাংক মোতায়েন করেছে, যারা পূর্ব ইউক্রেনের 'বিচ্ছিন্নতাবাদী'দের সাথে লড়ছে।
গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার
যুক্তরাষ্ট্র তাদের এম১ আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর জন্য তেমন আগ্রহী নয়, কারণ এই ট্যাংকগুলো তাদের হাতে থাকা সবচেয়ে উন্নতমানের মেইন ব্যাটল ট্যাংক। বর্তমানে আমেরিকার ট্যাংক উৎপাদনের সক্ষমতা আগের মতো নেই। তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে যে, বর্তমানে ইউক্রেনে পাঠানোর মতো অত্যাধুনিক এম১ আব্রামস ট্যাংক তাদের হাতে নেই।
ইউক্রেনের যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন বাড়ানোর মতো তেমন বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
আব্রামস ট্যাংক নিজেদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে না রেখে ইউক্রেনে পাঠাতে চাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেটি করতে হলে একেবারে গোড়া থেকে ট্যাংক তৈরির কাজে হাত দিতে হবে তাদেরকে। সে কারণে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত ইউক্রেনকে অপেক্ষা করতে হতে পারে।
তাছাড়া মার্কিন সেনাবাহিনীর গর্ব এই ট্যাংক। সে কারণে প্রশিক্ষণহীন ইউক্রেনীয়র হাতে দিলে যুদ্ধে ব্যাপক পরিমাণে এই ট্যাংক ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওয়াশিংটন তাদের এই অস্ত্রের সুনাম হারাতে দিতে চায় না, যেটি ইউক্রেনে তাদের ট্যাংক পাঠাতে অনাগ্রহ দেখানোর আরেকটি কারণ।
এ কারণেই এফ-১৬সহ অন্যান্য এয়ার সাপোর্ট চাইছে ইউক্রেন। কারণ, এয়ার কভার না থাকলে রাশিয়ার বিমানের সহজ শিকার হবে ন্যাটোর ট্যাংকগুলো।
তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্যাংক পাঠালে রাশিয়াও তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার একটি শক্ত কারণ দেখাতে পারবে, যেটি এতদিন তাদের হাতে ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র কেন তাদের মূল যুদ্ধাস্ত্র ইউক্রেনে পাঠাতে চায় না, তার একটি কারণ হতে পারে এটিও।
পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের ভুল
জার্মানরা ১৫টি লেপার্ড-টু ট্যাংক পাঠানোর সম্মতি জানালেও সেগুলো কবে পাঠাবে, তা নিয়ে কোনো নিশ্চিত তথ্য জানায়নি। মার্কিনীরাও তাদের ৩১টি ট্যাংক পাঠানোর সময় নিয়ে কিছু বলেনি।
এদিকে পোল্যান্ড তাদের ১৫টি লেপার্ড টু ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একইসাথে সোভিয়েত আমলের পুরনো ট্যাংকগুলোও পাঠানো যায় কিনা তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।
তবে ট্যাংক যতগুলোই পাঠানো হোক না কেন, সেটি যে রাশিয়ার বিশাল ট্যাংকবহরের সামনে ক্ষুদ্র হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাছাড়া অত্যাধুনিক ট্যাংক পরিচালনা করার মতো কোনো প্রশিক্ষণ নেই ইউক্রেনীয়দের। তাছাড়া এরকম বিশাল রাশিয়ান বহরের সাথে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতাও নেই তাদের।
ট্যাংক পরিচালনা বর্শা হাতে ধরে ছুঁড়ে দেওয়ার মতো কোন বিষয় নয়। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ট্যাংকগুলোকে ঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছরের প্রশিক্ষণও প্রয়োজন হতে পারে। রাশিয়া খুব সহজেই তাদের পুরো টি-৯০ ট্যাংক বহর ইউক্রেনে পাঠাতে পারে, যেখানে ইউক্রেনকে তাদের ন্যাটো মিত্রদের কাছ থেকে পাওয়া ট্যাংকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
ব্রিটেন থেকে পাওয়া ১৪টি চ্যালেঞ্জার টু, জার্মানি এবং পোল্যান্ড থেকে ১৪টি করে মোট ২৮টি লেপার্ড টু এবং ৩১টি মার্কিন আব্রামসকে যোগ করলে মোট ৭৩টি আধুনিক ট্যাংক হয়, যেটি আগামী কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের মধ্যে ইউক্রেনের হাতে পৌঁছাবে।
যদিও ন্যাটো ঘোষণা করেছে যে ইউক্রেনকে মোট ৩২১টি ট্যাংক দেওয়া হবে, তবে সেগুলো আধুনিক ট্যাংক নাকি সোভিয়েত আমলের পুরনো জঞ্জাল তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
যথেষ্ট এয়ার কভার না থাকলে পূর্ণশক্তির রুশ আর্মারড বাহিনী এবং সাড়ে তিন লক্ষ রুশ সৈন্যের বহরের সামনে ন্যাটোর এই প্রচেষ্টা তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়বে।
২০২২ সালে রাশিয়াকে কীভাবে ঠেকিয়ে রেখেছিল ইউক্রেন?
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সামর্থ্য যতটুকু ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে বহুগুণ ভালো প্রতিরোধ দেখিয়েছে ইউক্রেনীয়রা। তবে ইউক্রেন সেটি কীভাবে করেছে, তা ভুলে গেলেও চলবে না। ইউক্রেনীয়রা সাহসী বীর, কিন্তু অতিমানব নয়।
ইউক্রেন গত বছর রুশদেরকে ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে রুশদের তুলনায় তাদের বিশাল সংখ্যক সৈন্যের কারণে। গতবার রুশরা দেড় লক্ষের সামান্য বেশি সংখ্যক সৈন্য নিয়েই অভিযানে নেমেছিল। তবে পুতিন যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন সেভাবে ঘটনা ঘটেনি।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। রুশরা এমনভাবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করছে, তাতে ভয়ঙ্কর ও মারণাত্মক যুদ্ধ হলেও শেষমেশ এটি ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। রুশ বহরের সামনে ন্যাটোর সামান্য কিছু ট্যাংক দিয়ে একে প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব হবে।
তাছাড়া রাশিয়ার লজিস্টিকসের পাশাপাশি ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থাও রুশ সৈন্যদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছে।
ইউক্রেনের পক্ষে থাকা এই বিষয়গুলোই এখন তাদের বিপক্ষে কাজ করছে। যুদ্ধকৌশলের অনেকটাই রাজনৈতিক খেলা। ইউক্রেনীয়দেরকে পশ্চিমদিকে সরিয়ে ফেলা এবং যত দ্রুত সম্ভব এই অভিযানকে থামানো যায়, সেটি নিয়ে এখন চিন্তাভাবনা করা উচিৎ। কেবল শক্তিপ্রয়োগ আর যুদ্ধ করে এই আক্রমণকে থামানো সম্ভব হবে না।
কিয়েভের পাশাপাশি তাদের পশ্চিমা মিত্ররাও এই পরিণতি দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আগামী ছয় মাসের মধ্যেই পূর্ণশক্তির রুশবাহিনীর সামনে ইউক্রেনের ক্ষুদ্র বাহিনী ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ন্যাটো কেবল তাদের অর্থ এবং যুদ্ধাস্ত্রের ভাণ্ডার খালি করতে থাকবে এবং পুরো বিশ্বকে আবারো এক ক্ষমতার যুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য করবে, যার ফলাফল শূণ্য ছাড়া কিছুই নয়।