ইরাক আক্রমণে বুশ আমাদের কাজের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তিনি 'মিথ্যুক': সিআইএ'র সাবেক অ্যানালিস্ট
ইরাকে মার্কিন আক্রমণের ২০ বছর পূর্ণ হওয়ার কিছুদিন আগে মার্কিন গণমাধ্যম ইনসাইডার-এর কাছে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক দুই কর্মকর্তা। তারা জানিয়েছেন কীভাবে বুশ প্রশাসন সিআইএর গোয়েন্দা তথ্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা ও সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে আল কায়েদার যোগসাজশ প্রমাণের চেষ্টা করেছে। যদিও সিআইএর জোগাড় করা তথ্য অনুযায়ী, সাদ্দাম আর আল কায়েদার মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না।
এ দুই কর্মকর্তার সিআইএতে কাজ করার বয়স একত্রে প্রায় চার দশকেরও বেশি। তাদের পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মনামে সাক্ষাৎকারটি সংক্ষেপে প্রকাশ করেছে ইনসাইডার। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির পরিমার্জিত অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।
অ্যালিস: ওয়াশিংটনে সবাই নিপাট ভদ্রলোক— কেউ বুশকে মিথ্যুক বলার মুরোদ দেখান না। তারা বুশের দোষ ঢাকতে ইনিয়েবিনিয়ে অন্যভাবে বলেন। কিন্তু বুশ মিথ্যা বলেছিলেন সবাইকে। আমি বলতে চাচ্ছি, বুশ জানতেন তিনি যেসব কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন সেগুলো সত্য ছিল না। তিনি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনিশ্চিত বিচারকে গ্রহণ করেছিলেন। আমরা বলতাম, 'আমাদের মনে হচ্ছে ইরাক তার পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের কাছে এ বিষয়ে বেশি নিশ্চয়তা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি…।' বুশ বাইরে এসে সেটাকে তথ্য বা ফ্যাক্ট হিসেবে উপস্থাপন করতেন। তিনি এ কাজ বারবার করেছেন।
একই কাজ করেছেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনিও। মোহাম্মদ আত্তা (নয়-এগারোর হামলার প্রধান ছিনতাইকারী) প্রাগে ইরাকি গোয়েন্দাদের সঙ্গে দেখা করেছেন— এ ধারণাকেও তিনি ফ্যাক্ট হিসেবে চালিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যটা হলো, ওই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বিস্তর সন্দেহ ছিল।
সিআইতে আমাদের কাজ ছিল এসব অসম্ভব ধারণাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। আর আমরা সেটার চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু আমাদের পক্ষে খুব বেশি করা সম্ভব হয়নি। আক্রমণের জন্য হোয়াইট হাউসের একটা ওজরের দরকার ছিল। আর সবচেয়ে কাছাকাছি তারা যেতে পেরেছিল, নয়-এগারোর হামলার ক্ষেত্রে ইরাক আটার মাধ্যমে আল কায়েদাকে সহায়তা করেছিল— এ ভুল অভিযোগের মাধ্যমে।
বব: আমাদের ইরাকি বিশ্লেষকেরা বলছিলেন, আল কায়েদা আর সাদ্দাম হোসেনের মধ্যে আদর্শগত দিক থেকে বিস্তর ফারাক। সাদ্দাম ছিলেন খাঁটি সেক্যুলারপন্থী। সাদ্দাম অবশ্য জানতেন তার দেশে আল কায়েদার উপস্থিতি ছিল। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ায় এসব ব্যাপারে তাকে জানতে হতোই। কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে কার্যকরী কোনো সম্পর্ক ছিল না। বরং পুরো ব্যাপারটা ছিল নজরদারির।
অ্যালিস: আজকের দিনে মানুষ বলেন, বুশ আক্রমণকে যৌক্তিক দেখানোর উপায় খুঁজছিলেন। কিন্তু আদতে তিনি সবার কাছে যুদ্ধটাকেই বেচতে চাইছিলেন। আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়েই গিয়েছিল, আর কোনো গোয়েন্দা তথ্যই তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারত না।
বব: নয়-এগারোর বিমান ছিনতাইকারীদের নিয়ে কাজ করছিলেন আমাদের একদল বিশ্লেষক। আমাদের অনেকেই ছিলেন রাশিয়ান বিশ্লেষক— তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ছিল সম্পূর্ণ নতুন স্থান। শীঘ্রই আমরা বুঝতে পারলাম, বুশ প্রশাসনের সব মনোযোগ কেবল তথাকথিত আত্তা ও ইরাকি গোয়েন্দাদের মিটিংয়ের ওপর। আমরা কোনো প্রমাণ পেলাম না। কিন্তু হোয়াইট হাউস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, তারা প্রত্যাশা করে আমরা কোনো প্রমাণ খুঁজে পাব। যেকোনো প্রমাণের জন্যই তারা মরিয়া হয়ে ছিল।
অ্যালিস: ব্রিফারদের মাধ্যমে এজেন্সির ওপর চাপ আসতে থাকল। তারা প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করে এসে আমাদেরকে সেগুলোর ফিডব্যাক জানাতেন। একবার আমি প্রেসিডেন্টের জন্য একটা ব্রিফিংয়ে ইরাকে আক্রমণ চালানোর ফলে আমাদের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহায়তার ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে তা লিখেছিলাম। কিন্তু আমাকে জানানো হলো, প্রেসিডেন্ট এসব শুনতে চান না। ইরাক নিয়ে সিদ্ধান্ত অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল।
বব: যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে বড় আকারে সৈন্য সমাবেশ শুরু করল। আপনি এত তেল, পরিবহন শক্তি খরচ করে পরে সাদ্দামের কথা শুনে তো ফিরে আসবেন না। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা ব্যাপারটা প্রথমে টের পেয়েছিল। তারা বলেছিল, 'হা ঈশ্বর, এ লোকেরা আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে। আমরা কী লিখি, তাদের গোয়েন্দারা এর প্রভাব নিয়ে কী বলেন — তা-তে আর কিচ্ছু আসে যায় না। তারা আক্রমণ করবেই।'
অ্যালিস: আমার মনে আছে, আমি জোর করে চাইতাম ব্যাপারটা ভুলে থাকতে। আমার মনে হতো, 'না, আমাদের ইরাক আক্রমণ করা একদমই উচিত হবে না, কারণ তাহলে এটা হবে আমাদের করা সবচেয়ে খারাপ কাজ।' কিন্তু একদিন সে ভুল ভাঙল, বুঝলাম ইরাকে আমরা আক্রমণ করতে যাচ্ছিই। ব্যাপারটা খুবই খারাপ ছিল। কারণ আল কায়েদাকে চূড়ান্তভাবে আঘাত করার আমাদের একটা দারুণ সুযোগ ছিল তখন। অথবা নিদেনপক্ষে আমরা সংগঠনটিকে এমন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারতাম, যেখান থেকে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। কিন্তু আমরা সব ঘেঁটে দিলাম। আমরা এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করলাম যা আইসিসের উত্থানের সূচনা করেছিল।
বব: ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকেরা মোহাম্মদ আত্তাকে নিয়ে এতই মগ্ন ছিলেন যে সিআইএ'র বিশ্লেষকেরা তার ওপর তিন বছর সময় ব্যয় করেন। আমার যতটুকু মনে হয়, সবকিছুর শুরু হয়েছিল আত্তা ও ইরাকি গোয়েন্দাদের প্রাগে মিটিংয়ের একটা অপ্রমাণিত ছবি থেকে। নয়-এগারোর হামলার কয়েক সপ্তাহ পরে ওটা আমাদের হাতে এসেছিল। খুবই অস্পষ্ট ওই ছবিতে হতে পারে আত্তাই ছিলেন, অথবা অন্য কেউ ছিল। তার মুখ ক্যামেরার দিকে পুরোটা ছিল না। আশেপাশে আরও তিনজন ছিলেন। যারা আমাদের এ ছবিটা দিয়েছিল, তারাও শেষ পর্যন্ত বলেছিল, আমরা যা খুঁজছি তা হয়তো ওই ছবিতে নেই। প্রথমে আমাদের ছবি চিহ্নিতকরণ দল জানিয়েছিল, ছবির ব্যক্তিটি আত্তা হওয়ার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জানাল, ছবির লোকটির পরিচয় তারা নিশ্চিত করতে পারছে না।
বব: কিন্তু প্রশাসন তা-তে থেমে যায়নি। তারা আত্তার প্রাগে যাওয়ার প্রমাণের জন্য মরিয়া তখন। এরপর যখন আমাদের ও এফবিআই'র সোর্সদের কাছ থেকে তথ্য আসতে শুরু করল, তখন আমাদের সন্দেহ বেড়ে দাঁড়াল যে আত্তা আদতে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাইরে গিয়েছে কি-না। কিন্তু প্রশাসন বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল. 'আমরা ইরাকের ক্ষেত্রে কোনো অ্যাঙ্গেল উহ্য যেন না রাখি, এ ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে।' এমনকি শেষ দিকে তারা এসব কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আমাদের কর্মীদের ওপর দোষ দিতে লাগল, আমাদের বিশ্লেষকদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল।
অ্যালিস: ডিক চেনি আমাদের সকল ধরনের সতর্কতাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। যেসব তথ্যের ব্যাপারে আমরা তাকে নিশ্চিত না হওয়ার কথা অথবা যেগুলো একেবারে নিশ্চিতভাবেই সত্য ছিল না বলে জানিয়েছিলাম, তিনি সব ভুলে গিয়ে সেগুলোকে সত্য বলে জানান দিলেন।
বব: আমার যা ধারণা, সিআইএ'র ডেপুটি ডিরেক্টর জন ম্যাকলাফলিন একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে হোয়াইট হাউজকে বলে দিয়েছিলেন তারা যেন ইরাক বিষয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ করে।
বব: আমাদের একটা আলাদা ভল্ট ছিল, পুরো একটা কক্ষের মতো বড়। ওটায় কোড ব্যবহার করে প্রবেশ করতে হতো। ওই ভল্টের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত কেবল প্রিন্ট করা কাগজ ছিল। আমার শাখা থেকে তিন-চারজন আর আমি মিলে সেগুলো পড়ে পড়ে সব আরব নাম হাইলাইট করতাম। একটা স্তূপ শেষ হলে বসেরা আবার নতুন স্তূপ ধরিয়ে দিতেন। তারা আমাদেরকে বারবার পুনরায় তদন্ত করতে বলতেন। আমরা টেলিভিশনে শুনতাম, ডিক চেনির মতো বড় বড় কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাগে মিটিং হয়েছিল। কিন্তু ওটা একটা মিথ্যে কথা ছিল।
অ্যালিস: আমাদের সময় (সিআইএ পরিচালক জর্জ টেনেটের সময়) একটা সমস্যা ছিল, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সিআইএ'র ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল। তাই প্রেসিডেন্ট খারাপ হলে, সিআইএও খারাপ হয়ে যেত। এটা অকার্যকর একটা সম্পর্ক। আর আমি মনে করি গোয়েন্দাসংস্থার বিশ্লেষণধর্মী সিদ্ধান্তগুলো জাতির কাছে অকপটে প্রকাশ করা উচিত। বুশ বা ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট, তখন তথ্য কেবল প্রেসিডেন্টের কাছে না থেকে সবার কাছে থাকা উচিত। যখন তথ্য কেবল প্রেসিডেন্ট জানেন, তখন আমরা এমন পরিস্থিতিতে পড়ে যাই, যেখানে যুদ্ধ থামানোর আর কোনো উপায় থাকে না।
বব: যখন খোদ প্রেসিডেন্ট বলে দেন, তিনি সত্যটা শুনতে চান না, তখন এজেন্সির জন্য বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়ে। এরকমটা হলে অনেকেই এজেন্সি ছেড়ে দেবে, অন্য কোথাও যোগ দেবে। আর প্রশাসনের মুখের ওপর সত্য বলার মতো এ ধরনের সাহসী লোকগুলোকেই বিচার-বিশ্লেষণের কাজে রাখতে হবে।
অ্যালিস: যখন কারও কাছে কোনো ধারণা থাকে না যে ওই সময় প্রেসিডেন্ট গোয়েন্দাদের কাছ থেকে কী জেনেছিলেন, কখন জেনেছিলেন— তখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যেখানে বুশের মতো প্রেসিডেন্ট দাবি করতে পারেন, 'হ্যাঁ, বেশ ওখানে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না, কিন্তু আমাদেরকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে।' না, আপনাকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়নি। আপনি বরং ত্রুটিপূর্ণ তথ্য দাবি করেছিলেন। কারণ ইরাকে আক্রমণের জন্য আপনার কেবল সেসব গোয়েন্দা তথ্যেরই দরকার ছিল, যেগুলো আপনি আক্রমণের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারতেন। আর আপনার ইচ্ছা সফলও হয়েছিল।
বব: আমার দুজনই সিআইএ'র প্রতি একপ্রকার বিশ্বস্ততাবোধ করি। প্রশাসনের উচ্চ আসনে থাকা ডিক চেনির মতো কর্মকর্তাদের লেখা নোংরা ইতিহাসের প্রতি আমাদের ক্ষোভ রয়েছে। বুশ আর চেনি ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এস্টিমেট-এর বিশ্লেষণকে আমলে নেয়নি।
অ্যালিস: আমি চেনিকেও একজন মিথ্যাবাদী বলব। তিনি জানতেন তিনি যুদ্ধটাকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করছিলেন। এর জন্য তিনি সবকিছুকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কোনো বইপত্রেই দেখি তাকে মিথ্যুক হিসেবে দেখানো হয় না। কেউই রংচং মাখানো ছাড়া কিছু বলতে চায় না। কিন্তু আমি আর সেটা করছি না। শেষ পর্যন্ত আপনার কাউকে না কাউকে যা ঘটেছে তার জন্য দায়ী করতে হবে।