ভারতে নতুন পাঠ্যবই থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে মোগলদের ইতিহাস!
ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত তাজমহল ভারতের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কিন্তু এখন থেকে দেশটির শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্যবইয়ে তাজমহলের নির্মাতা মোগলদের সম্পর্কে আর শিখতে পারবেনা।
ভারতীয় শিক্ষার্থীদের নতুন পাঠ্যবই থেকে দেশটির মুসলিম ইতিহাস, দেশের বর্ণ বৈষম্য এবং আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিবরণ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। খবর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের।
সমালোচকরা বলছেন, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডাকে আরও বিস্তৃত করার প্রয়াসে ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক ইসলামী শাসকদের নিয়ে লেখা অধ্যায়গুলো হয় কাটছাঁট করা হয়েছে, না হয় বই থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এমনকি দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাসের বই থেকে 'কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস: দ্য মুঘল কোর্টস' নামক অধ্যায়টিই মুছে ফেলা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, পাঠ্যবই থেকে ২০০২ সালে ভারতের গুজরাট রাজ্যে সংঘটিত দাঙ্গার ঘটনাও মুছে ফেলা হয়েছে। যেখানে মোদি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় শত শত ভারতীয়-মুসলিম নিহত হন। ভারতের বর্ণপ্রথা, বর্ণ বৈষম্য এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে লেখা অধ্যায়গুলোও আর নেই বইতে।
তাছাড়া, যেসব অনুচ্ছেদে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের সাথে হিন্দু চরমপন্থীদের যোগসূত্রিতা দেখানো হয়েছে, সেসবও ছেঁটে ফেলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের কথা। বইতে একটি অনুচ্ছেদে লেখা ছিল: মহাত্না গান্ধীর 'হিন্দু-মুসলিম ঐক্য নিয়ে অবিচল সাধনা আদতে হিন্দু উগ্রপন্থীদের এতটাই উস্কে দিয়েছিল যে তারা গান্ধীকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করে।' নতুন বইতে এ লাইনটি নেই।
ভারতের ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং এর তৈরি নতুন পাঠ্যক্রমটির কাজ গত বছর থেকেই চলছে। ভারতের ২০টি রাজ্যের হাজার হাজার শ্রেণীকক্ষে পড়ানো হবে এসব নতুন বই।
সান্তা বারবারার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক উটাত্থ্যা চট্টোপাধ্যায় বলেন, "শিশুদের মনকে এখন সরাসরি আক্রমণ করা হচ্ছে। [নতুন এসব বইয়ের মাধ্যমে] আপনি মূলত এমন শিক্ষার্থী গড়ে তুলবেন যারা সামাজিক ন্যায়বিচারের ইতিহাস, গণতন্ত্রের ইতিহাস, বৈচিত্র্যের ইতিহাস এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কে খুব কমই জানে।"
বহু শতাব্দী ধরেই হিন্দু, মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবাসস্থল ভারত। মূলত ব্রিটিশ শাসনামলেই এখানকার সম্প্রদায়গুলোর মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। এরই ফলসূত্রিতে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারতে বিভক্ত হয় ভারতীয় উপমহাদেশ।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভারতে নরেন্দ্র মোদির অধীনে হিন্দু জাতীয়তাবাদ আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই এজেন্ডারই অংশ সংঘর্ষ, ভারতীয়-মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার আক্রমণ এবং সমগ্র ভারতজুড়ে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ের বৈপরীত্য সৃষ্টি করা।
চট্যোপাধ্যায়ের মতে, দেশটির পাঠ্যক্রম পরিবর্তন এই এজেন্ডারই আরেকটি অংশ। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্যগুলোর সরকার সেখানকার পাঠ্যবই 'সংশোধন' শুরু করেছে। কিন্তু এখন তা জাতীয় পর্যায়ে প্রসারিত হলো।
"আসলে এতদিন ধরে যা চলছিল তারই তীব্র বহিঃপ্রকাশ এটি। এটি দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসকে 'হিন্দু-করণ' করার একটি উপায়মাত্র, যেখানে বিদ্যমান অন্যান্য সব ইতিহাসকে উপেক্ষা করা হচ্ছে," বলেন তিনি।
ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর পরিচালক দীনেশ প্রসাদ সাকলানি পাঠ্যবই সংস্কারের বিষয়ে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে ভারতীয় মিডিয়ার সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, এসব সংশোধন 'বিশেষজ্ঞ কমিটি' দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মূলত শিক্ষার্থীদের কাজের চাপ কমাতে এটি করা হয়েছে।
সাকলানি বলেন, "কমিটি সুপারিশ করে যে এই অধ্যায়টি যদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে এটি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানকে কোনোভাবে প্রভাবিত করবে না এবং এর মাধ্যমে তারা একটি অপ্রয়োজনীয় বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারে।"
দেশটির অন্য এক মিডিয়া আউটলেটকে তিনি বলেছিলেন, "করোনার কারণে কন্টেন্টের চাপ কমানো হয়েছে।" তবে এই সিদ্ধান্তের সাথে বিজেপির জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন তিনি।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ বছরের মেয়াদে সরকারি কাউন্সিলের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে যুক্ত হন সাকলানি।
এদিকে বিজেপি নেতারাও পাঠ্যবই 'সংস্কারের' এই পদক্ষেপের প্রশংসা করছেন। তারা টুইটে বলেন, এটি একটি 'দুর্দান্ত সিদ্ধান্ত'। একইসাথে, ভারতের মোগল সাম্রাজ্য নিয়ে লেখা আগের অধ্যায়গুলোকে 'মিথ্যা ইতিহাস' হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা।
এ পরিবর্তনগুলোকে 'উদ্বেগজনক' আখ্যা দিয়ে চট্টোপাধ্যায় বলেন, শিক্ষার্থীদের বিশ্বদর্শন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
"এর মানে শিক্ষার্থীরা তাজমহল সম্পর্কে জানতে পারবে। এর ছবি দেখবে কিংবা সেখানে ঘুরতে যাবে। কিন্তু পাঠ্যবইতে তাজমহল তৈরির সময়কার সামাজিক, রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক বিবরণ জানতে পারবে না!" বলেন তিনি।
ভারতের পাঠ্যবই সংস্কারের এ পুরো ব্যাপারটি আদতে আমেরিকার স্কুলে জাতিগত পার্থক্য সম্পর্কে শিক্ষাদান নিয়ে চলমান বিতর্কেরও প্রতিফলক।
"এসব পদক্ষেপের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি ভয়। ইতিহাস-শিক্ষার মাধ্যমে যুক্তিবাদী বা প্রগতিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে শিক্ষার্থীরা- এটাই তাদের ভয়," বলেন চট্টোপাধ্যায়।
"আমেরিকা এবং ভারত উভয় দেশেরই বেশ জটিল ও চ্যালেঞ্জিং ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসবিদ বা ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে আমাদের কাজ হলো শিক্ষার্থীদেরকে জটিলতা এবং চ্যালেঞ্জগুলো বোঝানো," বলেন তিনি।
তবে, ভারতের পাঠ্যবই সংস্কারকে এরমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে বিদ্রুপ করা হচ্ছে। দেশটির ইতিহাসের মূল স্তম্ভ মুছে ফেলাকে অযৌক্তিক হিসেবে দেখছেন অনেকেই। 'চিত্রকর্ম থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে সম্রাটরা, বিভ্রান্ত চিত্রশিল্পীরা' শিরোনামে একটা ব্যাঙ্গাত্মক সংবাদপত্রের ছবি পোস্ট করে এক ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট।
অন্য একটি পোস্টে মোগল শাসনামলের একটি ছবি দেখানো হয়েছে। যেখানে সিংহাসনে বসা এক ব্যক্তি তার আশেপাশে থাকা বাকিদেরকে বলছেন, 'মনে হচ্ছে এখন সবাই শুধুমাত্র কাল্পনিক চরিত্র'।
আরেক টুইটার ব্যবহারকারী আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন: 'তাজমহল নির্মাণের জন্য ভারত তাহলে কাকে কৃতিত্ব দেবে? এলিয়েন!'