বিহার শরীফ: ভারতে দাঙ্গায় পুড়ে যাওয়া ১১৩ বছরের প্রাচীন লাইব্রেরি
প্রাচীন দেওয়ালে ছাপ ফেলেছে আগুনের কালি, মেঝেতে ছাইয়ের স্তূপ, তার মধ্যেই আধপোড়া আসবাব ও বইয়ের পাতার ছড়াছড়ি। ভারতে ১১৩ বছরের প্রাচীন এক মাদ্রাসা গ্রন্থাগারের এই হলো দশা; – যেখানে কিছুদিন আগেও ছিল সাড়ে চার হাজার বই। ছিল প্রাচীন পুঁথি আর অসাধারণ সুন্দর ক্যালিগ্রাফিতে লেখা ইসলাম ধর্মের নানান গ্রন্থ। খবর বিবিসির
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহার। এখানকার বিহার শরীফ শহরের একটি সুপরিচিত ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র মাদ্রাসা আজিজিয়া। লাইব্রেরিটি এই মাদ্রাসারই অংশ। গত ৩১ মার্চ একদল দাঙ্গাবাজ এটিকে পুড়িয়ে দেয়।
অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে হিন্দু ধর্মালম্বীদের পবিত্র উৎসব রাম নমবীর দিন। দাঙ্গাবাজ জনতা সেদিন লাঠি, পাথর, পেট্রোল বোমা নিয়ে হামলা করেছিল বলে স্থানীয়রা বিবিসিকে জানান। অগ্নিসংযোগের আগে তারা ধর্মীয়ভাবে উত্তেজক স্লোগানও দেয়।
বিহার শরীফ শহরের অনেক স্থানেই সেদিন হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন, ভাংচুরের করা হয় কিছু যানবাহন ও দোকানপাট। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাথে জড়িত থাকার ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে এরপর আটকও করেছে পুলিশ। এবিষয়ে তদন্ত এখনো চলমান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শতাধিক দাঙ্গাকারী মাদ্রাসার সামনের ফটকের তালা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে। তাদেরই কেউ কেউ শ্রেণিকক্ষগুলো এবং গ্রন্থাগারে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মাদ্রাসার বাবুর্চি আব্দুল গাফফার বলেন, 'হঠাৎ করে পোড়া পোড়া গন্ধ পেতে শুরু করি। দরজা খুলে দেখি, মাদ্রাসার অফিসের কাছে প্রচণ্ড গণ্ডগোল হচ্ছে। দাঙ্গাকারীরা ছাত্রাবাসের দিকেও যাচ্ছে। ভয়ে আমি একটি বিছানার নিচে লুকাই'।
ভয়াল সেই আগুনে লাইব্রেরিটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়, সঙ্গে অমূল্য বইগুলোও। এরমধ্যে ২৫০টি হস্তলিখিত বই ছিল। আরো ছিল বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি ও প্রাচীন আসবাব।
গ্রন্থাগারটি বেশিরভাগ সময় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাই ব্যবহার করতো। ৫০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসিকে থাকে ১০০ জন। তবে রমজান উপলক্ষে ক্লাস বন্ধ থাকায়, ভাগ্যক্রমে তারা ঘটনার দিন মাদ্রাসায় ছিল না।
মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে একটি দাতব্য - সোগহারা ট্রাস্ট। এর সভাপতি এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্য রাখা সৈয়দ সাইফুদ্দিন ফিরদৌসী আক্ষেপ করে বলেন, 'ভবন ও আসবাবের ক্ষতি হয়তো পূরণ করা যাবে, কিন্তু জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেল'।
তিনি জানান, এর আগে ২০১৭ সালেও মাদ্রাসা ভবনটিকে নিশানা করা হয়েছিল। তখন পুলিশ এক বছর ধরে মাদ্রাসাটি পাহারা দিয়েছে।
মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাতা বিবি সোগহারা। প্রয়াত স্বামী আব্দুল আজিজের স্মরণে তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৬ সালে প্রথমে মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয় পাটনা শহরে, পরে এটিকে বিহার শরীফে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৪,০০০ একর জমিসহ নিজের সম্পত্তি দাতব্য সংস্থাকে দান করেন সোগহারা। এই দাতব্য বা ট্রাষ্ট তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে সম্পত্তির আয় দ্বারা মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষাদান চালিয়ে নেওয়া যায়, দিনদরিদ্রদের সাহায্য করা যায়।
সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে বিহারে বেশকিছু স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল গড়েছে সোগহারা ট্রাস্ট, এসব প্রতিষ্ঠান আজো সচল রয়েছে।
ফিরদৌসী বলেন, 'বিবি সোগহারা ছিলেন একজন আলোকিত, সমাজ সচেতন ও জ্ঞানী নারী'। আত্মীয়দের মধ্যে বিলিবন্টন না করে তিনি তার সমুদয় সম্পত্তি সমাজ কল্যাণে দান করার সিদ্ধান্ত নেন।
এক শতক আগে রেখে যাওয়া তার এই দান থেকে আজো বিহার শরীফের অসংখ্য বাসিন্দা উপকৃত হচ্ছে। সোগহারা ট্রাস্টের একজন ব্যবস্থাপক ড. মুখতার উল হক জানান, ট্রাস্টের অর্থ দিয়ে গতবছর একটি চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। খুব শিগগিরই বিবি সোগহারার নামে একটি হাসপাতালও চালু করা হবে।
গ্রন্থাগারের ক্ষতিটা অপূরণীয়। তবে এরমধ্যেই ট্রাস্টের কর্মকর্তারা মাদ্রাসার ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামতের উপায় খুঁজছেন। আগামী ১ মে থেকে পাঠদানে ফিরতে চায় মাদ্রাসা।
ট্রাস্টটির হিসাবমতে, প্রধান প্রধান যেসব ক্ষতি তা মেরামতে ৩ কোটি ভারতীয় রুপি ব্যয় করতে হবে। তহবিল সহায়তা চেয়ে ট্রাস্টের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তরে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হবে।