১৩ বছরের জন্য বেতন ছাড়া বরখাস্ত হলেন বিশ্বের অন্যতম বেশি সাইটেশন পাওয়া স্প্যানিশ রসায়নবিদ
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সাইটেশন পাওয়া বিজ্ঞানীদের একজন স্প্যানিশ রসায়নবিদ রাফায়েল লুক। সম্প্রতি আগামী ১৩ বছরের জন্য তাকে বিনা বেতনে সাময়িক বরখাস্ত করেছে তার বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অভ কর্ডোবা। বিস্তারিত জানিয়েছে স্প্যানিশ গণমাধ্যম এল পাইস।
বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্চ সেন্টারে কাজ করার জন্য লুকের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তার নিজের কর্মস্থল। কারণ তিনি কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পূর্ণকালীন সরকারি অর্থায়নের চুক্তি করার পরও সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় ও রাশিয়ার ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেছিলেন।
৪৪ বছর বয়সী লুক স্পেনের অন্যতম প্রখ্যাত একজন বিজ্ঞানী। তথাকথিত সবুজ রসায়ন বিষয়ে তিনি প্রায় ৭০০টি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। এ বছর এখন পর্যন্ত লুক ৫৮টি গবেষণা প্রকাশ করেছেন, অর্থাৎ প্রতি ৩৭ ঘণ্টায় তার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
টানা পাঁচ বছর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সাইটেশন পাওয়া বিজ্ঞানীর তালিকায় ছিলেন লুক। লুকের মতো বিজ্ঞানীদের পাওয়ার জন্য সারাবিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। লুকের মতো প্রভাবশালী বিজ্ঞানীরা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, অ্যাকাডেমিক র্যাংকিংয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠান কয়েকশ ধাপ এগিয়ে যায়।
'আমাকে ছাড়া ইউনিভার্সিটি অভ কর্ডোবা সাংহাই অ্যাকাডেমিক র্যাংকিংয়ে ৩০০ ধাপ নিচে নেমে যাবে। তারা নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে,' নিজের সাসপেন্ড হওয়াকে 'আগাগোড়া ঈর্ষা' হিসেবে উল্লেখ করে এমন মন্তব্য করেছেন রাফায়েল লুক।
প্রায় এক দশক আগে সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সাইটেশনের অধিকারী বিজ্ঞানীদের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য আকর্ষণীয় নানা প্রোগ্রাম চালু করে। যেমন, দ্য কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি তখন গবেষকদের বছরে ৭৬ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।
শর্ত ছিল ওইসব গবেষকদের বছরে কেবল এক সপ্তাহ বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসে এসে থাকতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম দ্বিতীয় অ্যাফিলিয়েশন হিসেবে যুক্ত করতে হবে।
কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি ২০১৯ সালে কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হন লুক। লুকের দাবি কেবল তার গবেষণার খরচ, বিমানের বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ ও বিলাসবহুল হোটেলে থাকা বাদে তিনি সৌদি বা রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো অর্থ 'সরাসরি' গ্রহণ করেননি।
বর্তমানে বৈশ্বিক বিজ্ঞানচর্চার দুনিয়া 'প্রকাশ অথবা পতন' (পাবলিশ অর পেরিশ)-এর নীতিতে চলে। গবেষকেরা পিয়ার-রিভিউড জার্নালগুলোতে কতগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন এবং তাদের গবেষণা অন্য গবেষকেরা নিজেদের গবেষণায় কতবার উল্লেখ করেছেন তার ওপর নির্ভর করে গবেষকদের মূল্যায়ন করা হয়।
এ পদ্ধতির উদ্দেশ্য ভালো হলেও এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। নিয়মিত গবেষণা প্রকাশ করতে অনেক গবেষক চৌর্যবিদ্যা বা প্রতারণার আশ্রয় নেন। জানা গেছে, লুকের একটি গবেষণা ইরানের দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন সহগবেষকের নামসহ প্রকাশিত হয়েছে।
লুক জানান, তিনি অন্য ব্যক্তির গবেষণায় নিজেকে সহলেখক হিসেবে রাখতে কখনো কোনো অর্থ খরচ করেননি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, তার ওই গবেষণার বাকি ছয়জন ইরানি সহলেখকের সবাইকে তিনি চেনেন না। এদের কেউ যে অর্থ খরচের মাধ্যমে লুকের গবেষণায় নিজের নাম তুলেছেন, সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি লুক।
রাফায়েল লুক নিয়মিত গবেষণা প্রকাশ করছেন। কেবল গত বছরই তিনি প্রায় ১১০টি আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন। এ বছর এখন পর্যন্ত এ সংখ্যা ৫৮। তিনি স্বীকার করেছেন, গত ডিসেম্বর থেকে গবেষণার লেখাকে আরও 'ঘষামাজা করতে' তিনি চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছেন।
'ওই মাসগুলো দারুণ উৎপাদনমুখী ছিল। কারণ আগে কোনো কোনো আর্টিকেল লিখতে দুই থেকে তিনদিন লাগত, এখন সে কাজ আমি একদিনেই করতে পারছি,' লুক বলেন। তিনি দাবি করেছেন, কেবল তার লেখাকে ইংরেজিতে আরও বেশি অর্থবহ করে তুলতেই তিনি চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন। এছাড়া গণহারে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনোপ্রকার সম্পর্ক থাকার কথাও তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন স্প্যানিশ এ রসায়ন পণ্ডিত।
২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ইউনিভার্সিটি অভ কর্ডোবায় নিজের কার্যক্রম বন্ধ করেছেন রাফায়েল লুক। ২০১৯ সালে কিং সৌদ ইউনিভার্সিটির সঙ্গে এক প্রকল্পে কাজ করার সময় একটি গবেষণাপত্রে লুক 'ভুলক্রমে' রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক হিসেবে স্বাক্ষর করে ফেলেন। এ ঘটনায় কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত শুরু করে এবং লুককে ১৩ বছর বিনা বেতনে সাসপেন্ড করে।
'তাদের আমার বিরুদ্ধে রাগ আছে কারণ আমি একজন কর্মদক্ষ বিজ্ঞানী এবং সবাই আমাকে পছন্দ করেন। কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয় আমার পাশে ছিল বলে আমার কখনো মনে হয়নি, যদিও আমিই তাদেরকে সাংহাই র্যাংকিংয়ে তুলেছি। তাদের ওই র্যাংকে স্থান পাওয়া পুরোটাই আমার কারণে,' লুক বলেন।