চীন কি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা নিতে পারবে?
গত ৬ এপ্রিল সাত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতোন এক বৈঠকে অংশ নেন ইরান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এর এক মাস আগেই কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণা দিয়ে- বিশ্ববাসীকে চমকে দেন দুই দেশের শীর্ষ জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। অনেক বছর ধরে দুই দেশের চরম বৈরি সম্পর্ক, সৌদি-ইরান প্রতিদ্বন্দ্বিতা আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন সংকট – এই প্রেক্ষাপটে ঘোষণাটি সবাইকে বিস্মিত করে। বিশ্লেষণ আল জাজিরার।
তার চেয়েও বিস্ময়কর ছিল এই যে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘকাল প্রভাব বিস্তার করা কোনো পশ্চিমা শক্তি নয়, সাপে-নেউলে শত্রুতার সৌদি-ইরান সমঝোতায় মধ্যস্ততা এসেছে সুদূর প্রাচ্য থেকে। অবশ্য এই সমঝোতায় পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরায়েলের ক্ষুণ্ণ হবারই কথা। পশ্চিমা দুনিয়ার কোনো শক্তিই হয়তো এ ধরনের সমঝোতার উদ্যোগ নিতো না। পাশাপাশি ইরানের কাছে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতাও ছিল না তাদের।
এসব দিক থেকে দেখলে চীন যে নাটকীয় কূটনৈতিক সাফল্য দেখিয়েছে তাতে চমকই লাগে। তাছাড়া, আঞ্চলিক বিভিন্ন শক্তি – ওমান ও ইরাক যেখানে বিগত কয়েক বছর ধরে সৌদি ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্ততা করতে ব্যর্থ হয়েছে – সেখানে বেইজিংয়ের অর্জনকে অবিশ্বাস্যও মনে হয়।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় পশ্চিমারা। এরমধ্যেই রুশ অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রধান ভূমিকা রাখছে বেইজিং। মস্কোর থেকে কিনছে বিপুল জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিভিন্ন কাঁচামাল। কূটনৈতিক চাপের মুখেও ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য মস্কোর সমালোচনা করতে চায়নি চীন, এজন্য বেইজিংয়ের কড়া সমালোচনা হয়েছে পশ্চিমা গণমাধ্যমে।
বৈশ্বিক সংঘাতগুলো নিরসনে এর আগে এতোটা গভীরভাবে জড়িত হয়নি চীন; বরং সচরাচর দ্বিধাই প্রকাশ করেছে। ফলে সৌদি-ইরানের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ – চীনের সেই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা থেকে সরে আসার মতো বড় ঘটনা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, বেইজিং বড় স্বপ্নই দেখছে। যেমন গেল ফেব্রুয়ারিতে সৌদি-ইরান আলোচনার যবনিকাপাত হতেই বেইজিং তাদের বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ (গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ) ঘোষণা করে। এর আওতায় 'বিভিন্ন দেশের মধ্যেকার মতপার্থক্য ও বিরোধ শান্তিপূর্ণ সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে' এমন লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
এরপর গত সপ্তাহে চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং বলেছেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্ততা করতেও আগ্রহী বেইজিং।
জার্মানির আর্নল্ড-বার্গস্ট্রেসার-ইনস্টিটিউট ফ্রয়বার্গ এর সহযোগী ফেলো জুলিয়া গুরোল-হ্যালার মনে করেন, সৌদি-ইরান চুক্তি 'চীনের ভবিষ্যৎ (মধ্যস্ততার) উদ্যোগগুলির উৎক্ষেপণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে'। আগের চেয়ে সংঘাতের মধ্যস্ততায় চীনের আগ্রহ এখন বেশি – রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে সন্ধি করিয়ে বেইংজিং পরোক্ষভাবে এই বার্তা দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সর্ববৃহৎ শক্তির ভারসাম্য নির্ধারক যুক্তরাষ্ট্র। তার প্রভাবও সবচেয়ে বেশি। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, চীন এমন সময় এসব উদ্যোগ নিল যখন এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষয়ে আসছে। সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কখনো উষ্ণতা, কখনোবা দেখা দিচ্ছে টানাপোড়েন। ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি থেকেও সরে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে ওয়াশিংটনের তড়িঘড়ি করে সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাও বিশ্বশক্তি হিসেবে তার অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ করেছে। এরমধ্যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রকে ঘর সামলাতেই ব্যতিব্যস্ত রেখেছে – মার্কিন জনতার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মোড়লগিরির বিষয়ে আপত্তি দেখা দিচ্ছে।
বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের ব্যর্থতার ফলস্বরূপ যা যা দিতে পারেনি – সেটা কি চীন দিতে পারবে?
সংক্ষেপে এর উত্তর হলো: মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত প্রভাব বাড়া সত্ত্বেও – চীনের নেই যুক্তরাষ্ট্রের আসন দখলের সক্ষমতা। কারণ, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আছে ডজন খানেক সামরিক ঘাঁটি; আর এমন মিত্ররা যাদের সুরক্ষার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ ওয়াশিংটন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তার এই গুরুভার হয়তো এখনই নিতে চায় না বেইজিং। বরং চীন চায়, এই অঞ্চলের নিরাপত্তার বিষয়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিক – সেই অবসরে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে লাভবান হওয়াটাই চীনের লক্ষ্য।
চীনের যেসব সুবিধা আছে
সৌদি-ইরান চুক্তির আগেই, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে চীন।
সৌদি আরব ও ইরানের উভয়েরই শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার হলো চীন। এশীয় পরাশক্তিটি উভয় দেশেরই প্রধান রপ্তানি পণ্য জ্বালানি তেলের প্রধান ক্রেতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, এই সম্পর্কের বুনিয়াদকে আরো শক্তিশালী করেছে – ২০২১ সালে ইরানের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তি এবং ২০২২ সালে সৌদি আরবের সাথে বৃহত্তর কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে।
সৌদি ও ইরানের বাইরেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের দিকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে বেইজিং। এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে ২০১৩ সালে শুরু হওয়া চীনের সুবিশাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। বিআরই এর আওতায়- এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যে- সমুদ্র বন্দর, মহাসড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্য রয়েছে।
২০০৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে মোট ২৭৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম বিনিয়োগকারীও বেইজিং। ইরাক থেকে তেল এবং কাতার থেকে গ্যাস কেনে চীন। একইসঙ্গে অস্ত্র রপ্তানি করছে আলজেরিয়া, মরক্কো, তুরস্ক, মিশর ও সৌদি আরবে। মিশরকে কায়রোর অদূরে নতুন রাজধানী নির্মাণে সহযোগিতা করছে চীন, মক্কা নগরীতে নির্মাণ করেছে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে তিনদিনের সফরে সৌদি আরব আসেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এই সফরকালে তিনি আরব লীগ এবং গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত দেশগুলোর সাথে চীনের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠান করেন। সৌদি আরবের নেপথ্য শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এই সফরকে তার দেশের সাথে চীনের সম্পর্কের 'এক নতুন ঐতিহাসিক যুগের' সূচনাকারী হিসেবে অভিহিত করেন।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অসামান্য অগ্রগতি করেছে চীন। হুয়াওয়ের মতো কোম্পানির মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক দরে ফাইভ-জি পরিষেবা চীন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশকে দিতেও পারবে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রিসপন্সিবল স্টেটক্রাফট -এর নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা ট্রিটা পার্সি বলেন, এসব কিছু বেইজিংকে এ অঞ্চলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একটা প্রভাব এনে দিয়েছে। যার সুবাদেই অতীতের মধ্যস্ততাকারীরা ব্যর্থ হলেও – সৌদি-ইরানের ক্ষেত্রে চীন সফল হয়েছে। কারণ, অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চীনের সুদৃষ্টিতে থাকতে চায়।
তার চেয়েও ভালো দিকটি হলো – সবাই চীনকে আদর্শিকভাবে নিরপেক্ষ বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে গণ্য করে। কারণ, বেইজিং মধ্যপ্রাচ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি নিয়ে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। মানবাধিকার নিয়েও করেনি উচ্চবাচ্য, ফলে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে চীনকে নিয়ে বিতর্ক নেই তেমন, যা বহুলাংশে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে।
তাছাড়া, যেকোনো মূল্যে – যেকোনো উপায়ে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে হবে এমন নীতি আছে যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্যপ্রাচ্যে এমন বিশেষ কোনো অঙ্গিকারে নিজেকে জড়ায়নি বেইজিং। এই অঞ্চলের দেশগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার নজিরও নেই চীনের।
পার্সি আল জাজিরাকে বলেন, 'এসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাটাই চীনের প্রতি তাদের অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গির একমাত্র কারণ নয়। তাদের দৃষ্টিতে চীনের আচরণ যথেষ্ট শালীন, বেইজিং কাউকে হুমকি দেয় না, আর না আছে তার হুমকির কারণ হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা'।
মধ্যপ্রাচ্যে এমন সুনাম দূরে থাক, লাখো দুর্নাম আছে যুক্তরাষ্ট্রের। এমনকী ঐতিহ্যবাহী অংশীদারদের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বিরূপ ধারণা আছে। তার ওপর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের অস্বস্তি আরও বেড়ে গেছে বলেও পার্সি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, 'তারা দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র পাঁচদিনের মধ্যে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আর্থিক ব্যবস্থার এই নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার প্রচণ্ড শক্তিশালী এক হাতিয়ার। এই চাবিকাঠি যার হাতে সেই আমেরিকা গত ২০ বছরে দায়িত্বশীল আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। বেপরোয়া কারো হাতে এই শক্তি খুবই বিপজ্জনক, যা আমেরিকাকে হুমকি হিসেবে নেওয়ার আরেক কারণ'।
চীন ভিন্ন ধরনের শক্তি কেন?
চীন মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উদ্যমী হলেও – এখানে ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের অবস্থানকে উৎখাত করতে চায় না। আর সে চেষ্টাও দেশটি করছে না বলে মন্তব্য করেন সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন ইনস্টিটিউট -এর অধ্যাপক ফান হংডা।
চীনের ক্ষমতার প্রধান উৎস তার অর্থনৈতিক প্রভাব এবং বিআরআই এর মতো প্রকল্পগুলো। মধ্যপ্রাচ্যে আপাতত এসব বিষয়ই রক্ষা করতে চায় বেইজিং - বলেন তিনি।
'চীন কখনো মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়নি। আমার মনে হয় না, এইক্ষেত্রে আমেরিকার জায়গা দখলের কোনো পরিকল্পনাও চীনের আছে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা এমন অনেক কাজই করেছে যা চীনের পছন্দ নয়। এক কথায়, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক রক্ষায় চীনের স্বতন্ত্র নীতি ও পদ্ধতি রয়েছে'।