অবরুদ্ধ ইমরানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সমাপ্তির দিকে?
নিরাপত্তা বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে লাহোরের জামান পার্কের বাসভবনে অবরুদ্ধ রয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফের বিরুদ্ধে কঠোর দমনপীড়নে মদদ দিচ্ছে সামরিক বাহিনী। চলছে পিটিআই নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়। ব্লুমবার্গ অবলম্বনে।
চলতি মাসের শুরুতে ইমরান খানের গ্রেপ্তার নিয়ে উত্তাল হয় পাকিস্তান। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। ক্ষুদ্ধ জনতা সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা করে। এই হামলার জন্য পিটিআই - এর সাথে যুক্ত ১০ হাজার জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এরমধ্যেই জেলে রয়েছেন দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা, চলতি সপ্তাহে চাপের মুখে পিটিআই ছেড়েছেন দুই ডজনের বেশি শীর্ষ নেতা।
পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করছে, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে হামলার জন্য যারা দায়ী তাদেরই বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। যদিও পর্দার আড়ালে তারা এটা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বী এবং অতুলনীয়। অক্টোবরে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দিনক্ষণ রয়েছে, তার আগেই ইমরান ও তার দলের সাংগঠনিক শক্তিকে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে তারা। এমনটাই জানান দেশটির সামরিক বাহিনীর চিন্তাভাবনার বিষয়ে অবহিতরা।
অতীতে পাকিস্তানের সাবেক অনেক প্রধানমন্ত্রীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। কেউ পেয়েছেন নির্বাসন, কাউকে আবার হত্যাও করা হয়। জেনারেলদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো ইমরান তাদের মতোই পরিণতি হওয়ার সমূহ বিপদের মুখে।
খানের সাথে সেনাবাহিনীর আদায়-কাচকলায় সম্পর্ক অবশ্য চিরকালের নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেনারেলদের সমর্থনেই তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু, পরবর্তীতে শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়েই তার আজকের দুর্দশার সূত্রপাত। যে সামরিক বাহিনী স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ সময় পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ইমরান অঘোষিত এক রেড লাইন অতিক্রম করেন।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ এবং লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র ফেলো আয়েশা সিদ্দিকার মতে, "ইমরান খানের পথচলা (রাজনৈতিক ক্যারিয়ার) এখানেই শেষ। কিন্তু, প্রশ্ন হলো – তার যে জনসমর্থন, সেটা কি তারা কেড়ে নিতে পারবে?"
ইমরান খানের বহির্বিশ্ব এবং সাধারণ জনতার সাথে যোগাযোগ ক্ষমতাকে এরমধ্যেই খর্ব করা হচ্ছে। গত বুধবার ব্রিটিশ আইনপ্রণেতাদের সাথে পাকিস্তানের ক্রমঃঅবনতিশীল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে তার একটি ভার্চুয়াল কলে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, তার আগেই পিটিআই চেয়ারম্যানের বাসবভনের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বলে ব্লুমবার্গ নিউজকে জানান খানের ঘনিষ্ঠ একজন সহচর জুলফি বুখারী।
আর শুক্রবার একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইমরান ও তার স্ত্রীকে 'নো-ফ্লাই' লিস্টে যুক্ত করা হয়েছে। তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
অথচ গত বছরই গুপ্তহত্যা চেষ্টা থেকে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে ফেরেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এবিষয়ে ব্লুমবার্গ যোগাযোগ করলে- কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
গত বছর পার্লামেন্টে এক অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই নতুন করে নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে জোর রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন ইমরান। শাহবাজ শরীফের দুর্বল জোট সরকারের তীব্র নিন্দা-সমালোচনা করেছেন। শাহবাজ এবং তার জোট শরীক পিপিপি পাকিস্তানের গতানুগতিক অভিজাত পরিবারতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। ইতঃপূর্বে সামরিক বাহিনী এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার বড় ভাই নওয়াজ শরীফকে উৎখাত করে নির্বাসন দেয়। ইমরান ও তার সমর্থকদের চোখে, সেনাবাহিনীর সাথে আরো আপোষকামী শাহবাজ দুর্নীতিগ্রস্ত, সুযোগসন্ধানী এবং ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
অন্যদিকে, ইমরান খান 'ক্যারিশম্যাটিক' একজন নেতা এমনটাই মনে করে জনতার সিংহভাগ। সাবেক এই ক্রিকেটিয় কিংবদন্তীর আবেদনও সর্বব্যাপী। প্লেবয় জীবনযাপন থেকে ধার্মিক হয়ে ওঠা, বা একজন নেতা হিসেবে তার খোলামেলা কথাবার্তা – সমাজের প্রায় সর্বস্তরকে আকৃষ্ট করে। জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়তেই থাকে, এভাবে এক পর্যায়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সুনজরেও আসেন, এই সম্পর্কের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা বিস্ময়কর বলেই বোধ হয়।
তবে জনতার মধ্যে সমর্থন আজো দৃঢ় তার। চলতি বছরের শুরুতে গ্যালোপের এক জরিপে দেখা যায়, পাকিস্তানের ৬১ শতাংশ মানুষ তাকে সমর্থন করেন, যা গত বছরের জানুয়ারিতে ছিল মাটর ৩৬ শতাংশ। একইসময়ে শাহবাজের জনপ্রিয়তা ৫২ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে।
সামরিক বাহিনীর হর্তাকর্তাদের জন্য এটাই বিষম এক সমস্যার উদ্রেক করেছে। কারণ, নির্বাচনে অংশ নিতে পারলেই বিপুল ভোটে জিতবেন ইমরান, তার এমন কোনো 'যোগ্য রাজনৈতিক' বিপক্ষও নেই যাকে সেনাবাহিনী সমর্থন দিতে পারবে। এমন মন্তব্যই করেন লন্ডন-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা – রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী ফেলো টিম উইলাসে-উইলসে।
পাকিস্তান চরম এক অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রেকর্ড মূল্যস্ফীতিতে জনতা ক্ষুদ্ধ। আর্থিক সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে পুনরুদ্ধার প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা চলছে। এই অবস্থায়, নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সামরিক বাহিনীর সরাসরি ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা খুবই কম। ১৫ বছর আগে পাকিস্তানের সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। যাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয় চরম জন-বিরোধিতা ও অসন্তুষ্টির মধ্যে দিয়ে।
পাকিস্তান যে বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে, তার দায় ক্ষমতা দখল করলে সামরিক বাহিনীর কাঁধেই চাপবে। ২৯৯ পাকিস্তানী রুপি দিয়ে এক ডলার কিনতে হচ্ছে। বন্ড বাজারেও দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। চলতি বছর ২০ শতাংশ বিনিময় মান হারিয়েছে পাকিস্তানী রুপি। হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম বাজে পারফর্ম করা মুদ্রা।
উইলাসে-উইলসে বলেন, "সেনাবাহিনীর প্রধান সমস্যা হলো – তারা ইমরানের বিরুদ্ধে যত পদক্ষেপ নেবে ততোই বাড়বে তার জনপ্রিয়তা। এমনকী এতে কর্প কমান্ডার পর্যায়ে বিভাজন দেখা দিতে পারে – কারণ তারা সামরিক বাহিনীর সাথে জনতার দূরত্ব বেড়ে চলার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবেন। ফলে অভ্যুত্থানের পথে না হেঁটে নির্বাচনের তারিখ পেছানোসহ ভিন্ন ধরনের যত পন্থা আছে – সবই প্রয়োগের কথা ভাববে সেনাবাহিনী।"
ক্ষমতায় থাকার সময় ইমরানের সাথে সামরিক বাহিনীর সখ্যতা ছিল গভীর। দেশ শাসনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকা দরকার, ক্ষমতায় এসে তিনি প্রকাশ্যেই এমন স্বীকৃতিও দেন। বাড়ান প্রতিরক্ষা বাজেট। কিন্তু, ২০২১ সালে ইমরান খান আমেরিকা-বিরোধী বক্তব্য দিতে শুরু করেন। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দেশকে চীন ও রাশিয়ার বলয়ে নিতে উদ্যোগী হন। তখন থেকেই তার সাথে সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। চোখের মণি থেকে রাতারাতি হয়ে ওঠেন চক্ষুশূল।
তবে শুরুর দায়টা তারই। তিনিই সেনাবাহিনীর সাথে ঠাণ্ডা উত্তেজনাকে অগ্নিকুণ্ডের রূপ দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে। বাজওয়া পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা- আইএসআই এর প্রধান হিসেবে তার পছন্দের একজনকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন, সেই জায়গায় ইমরান চাইছিলেন তার পছন্দের কর্মকর্তাকে। শেষপর্যন্ত জয়ী হন বাজওয়া-ই, কিন্তু এই বিরোধই ইমরানকে উৎখাতের বীজ বুনে দেয়।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা- ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো মাদিহা আফজাল মনে করেন, ইমরান খানের বিরুদ্ধে এপর্যন্ত সামরিক বাহিনী যা করেছে, সেটা তাদের চিরাচরিত 'প্লে-বুকের'ই অংশ।
"এটা যদি সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে বলতেই হয় ইমরান খান, তার দল এবং সর্বোপরি পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে" - যোগ করেন তিনি।