ভারতে পাঠ্যবই থেকে বাদ গেল ‘বিবর্তনবাদ’, ‘পর্যায় সারণি’
ভারতে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে 'বিবর্তনবাদ', 'পর্যায়বৃত্ত সারণি' ও 'শক্তির উৎস' নামের বিজ্ঞানভিত্তিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চলতি মাসে শুরু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষে এ পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। খবর নেচার ডটকমের।
দেশটির দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই থেকে 'বিবর্তনবাদ' সরিয়ে ফেলা হতে পারে বলে গত মাস থেকেই গুঞ্জন ছিল। এর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদ করে পিটিশনে স্বাক্ষরও করে।
কিন্তু এবার শুধু বিবর্তনবাদই নয়, ভারতের পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে একঝাঁক বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়। আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু সম্পর্কিত কয়েকটি বিষয়ও শিশুদের আর পড়ানো হবে না।
এছাড়াও জীববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও ভূগোলের পাঠ্যসূচী থেকেও বেশ কয়েকটি বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে।
দেশটির স্কুলভিত্তিক কারিকুলাম ও পাঠ্যবই প্রণয়নের দায়িত্বে রয়েছে 'দ্য ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং' (এনসিইআরটি) কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটি কর্তৃক গত মে মাসের শুরুতে নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের পর এ বিষয়গুলো সকলের নজরে আসে।
ভারতের ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী প্রায় ১৩৪ মিলিয়ন স্কুলশিক্ষার্থী এ পরিবর্তনের ফলে ভুক্তভোগী হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। একইসাথে বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও গবেষকেরা এ পরিবর্তনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
বিবর্তনবাদের বিষয়টি সরিয়ে ফেলার প্রসঙ্গে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাইন্স-এডুকেশনের গবেষক জনাথান অসবর্ন বলেন, "বর্তমানে আমরা অন্তত এটা বুঝি যে, বিবর্তনবাদ ছাড়া কেউ যদি জীববিজ্ঞান পড়ান তবে সেটা প্রকৃতপক্ষে জীববিজ্ঞানের পড়াশোনা হবে না। বিবর্তনবাদ জীববিজ্ঞানের এতটাই মৌলিক বিষয়।"
অন্যদিকে পর্যায় সারণি সরিয়ে ফেলার প্রসঙ্গে জনাথান অসবর্ন বলেন, "পর্যায় সারণি ব্যাখ্যা করে যে ঠিক কীভাবে মৌলগুলো একত্রিত হয়ে এতটা ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পদার্থ সৃষ্টি হয়। এটা রসায়নবিদদের অন্যতম বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন।"
মুম্বাইয়ের টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সাইন্সেসের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষক মিথিলি রামচান্দ বলেন, "পানি দূষণ, বায়ু দূষণ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সকল কিছু পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমি ঠিক জানি না, এই বিষয়গুলো তাদের ঠিক কীভাবে প্রাসঙ্গিক নয় বলে মনে হলো।"
অন্যদিকে জনাথান অসবর্ন বলেন, "শক্তির বিভিন্ন উৎস সম্পর্কিত একটি অধ্যায় যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য শক্তির মতো বিষয়গুলো ছিল, সেটাও বাদ দেওয়া হয়েছে। সত্যি বলতে গেলে, বর্তমান বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুবই অদ্ভুত।"
কলকাতাভিত্তিক ক্যাম্পেইন গ্রুপ 'ব্রেকথ্রু সাইন্স সোসাইটি'র পক্ষ থেকে বিবর্তনবাদ সম্পর্কিত টপিকটি পাঠ্যবইয়ে পুনর্বহালের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সংস্থাটির অধীনে ৪,৫০০ জন বিজ্ঞানী ও শিক্ষক একটি আপিলে স্বাক্ষর করেছেন।
তবে এনসিইআরটির পক্ষ থেকে এ আপিল সম্পর্কে কোনো সাড়া দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে যদিও পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের বিষয়টি তদারকি করার জন্য সংস্থাটির একটি বিশেষ কমিটি রয়েছে, তবে সেই কমিটি পক্ষ থেকে এখনো অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাছে পরিবর্তনগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে এনসিইআরটির পক্ষ থেকে ওয়েবসাইটে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে টপিকটি অন্য একই ধরনের বিষয়গুলোর সাথে মিলে যাচ্ছে কি-না কিংবা কন্টেন্টের দুর্বোধ্যতা ও অপ্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি বিবেচনা করে এ পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
এ সম্পর্কে জওহরলাল নেহেরু সেন্টার ফর এডভান্সড সাইন্টিফিক রিসার্চের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী অমিতাভ জোশি বলেন, "কারিকুলাম রিভিশন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এছাড়াও বিবর্তনবাদের ক্ষেত্রে ভারতের বেশ কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে।"
আর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ আদিত্য মুখার্জি মনে করেন, কারিকুলামের পরিবর্তনের পেছনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর প্রভাব রয়েছে। এটি একটি ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী, আধাসামরিক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন যাদের সাথে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের সখ্যতা রয়েছে। সংস্থাটি মনে করে, ভারতের অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির কারণে 'হিন্দুত্ববাদ' হুমকির মুখে রয়েছে।
অন্যদিকে আদিত্য মুখার্জির সাথে 'পাঠ্যবইয়ে আরএসএসের প্রভাব' সম্পর্কিত গবেষণার সহযোগী জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ সুচেতা মহাজন বলেন, "যৌক্তিক চিন্তার বাইরে যেয়েও দেশে পশ্চিমা ধারণা ও এনলাইটমেন্টের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন চলছে। বিবর্তনবাদ তাদের সৃষ্টি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক। এখানে মূল টার্গেট ইতিহাস। তবে বিজ্ঞান এখানে ভুক্তভোগী।"