'টুইটার বন্ধের হুমকি দিয়েছিল ভারত', দাবি জ্যাক ডরসির; সরকার বলছে 'ডাহা মিথ্যা'
ভারতে কৃষক আন্দোলন চলাকালীন এ ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করেছে এমন অ্যাকাউন্টগুলোর কার্যক্রম 'সীমাবদ্ধ' না করা হলে ভারতে টুইটার বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন টুইটারের প্রাক্তন সিইও জ্যাক ডরসি। ডরসির এই অভিযোগকে 'ডাহা মিথ্যা' বলে অভিহিত করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
২০২১ সালের নভেম্বরে টুইটার ছাড়েন জ্যাক ডরসি। সোমবার তিনি বলেন, ভারত সরকারের নির্দেশে টুইটার কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট কিছু পোস্ট সরিয়ে না নিলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের উপর অভিযান চালানোর হুমকিও দিয়েছিল সরকার।
ইউটিউব নিউজ শো ব্রেকিং পয়েন্টস'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডরসি বলেন, "বিষয়টা এভাবে প্রকাশ পেয়েছিল: 'আমরা ভারতে টুইটার বন্ধ করে দিবো', যা কিনা টুইটারের জন্য একটি বড় বাজার। আরও বলা হয়েছে, 'আমরা তোমাদের কর্মীদের বাড়িতে অভিযান চালাবো', যা সত্যিই তারা করেছে; আর এটাই হলো ভারত, একটা গণতান্ত্রিক দেশ।"
এদিকে মোদি সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা, ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর জ্যাক ডরসিকে পাল্টা তোপ দেগেছেন। তিনি ডরসির অভিযোগকে 'ডাহা মিথ্যা' বলে অভিহিত করেছেন।
টুইটারে একটি পোস্টে তিনি বলেন, "কেউ জেলে যায়নি বা ভারতেও টুইটার 'বন্ধ করা' হয়নি। বরং ডরসির সময়ে টুইটার কর্তৃপক্ষের ভারতীয় আইনের সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে সমস্যা ছিল।"
এদিকে জ্যাক ডরসির মন্তব্যের পর আবারও মোদি সরকারের অধীনে ভারতে বিদেশি প্রযুক্তি জায়ান্টদের কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রতিবন্ধকতার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। গুগল, ফেসবুক এবং টুইটার তাদের প্ল্যাটফর্মে জাল বা 'ভারত-বিরোধী' কন্টেন্ট মোকাবিলায় যথেষ্ট কাজ করছে না কিংবা নিয়ম মেনে চলছে না, এমন অভিযোগ তুলে প্রায়ই তাদের সমালোচনা করেছে মোদি সরকার।
টুইটারের সাবেক সিইওর সাম্প্রতিক মন্তব্য বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, কারণ ভারতে কার্যক্রম পরিচালনা করা বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো সাধারণত জনসমক্ষে দেশটির সরকারের সমালোচনা করে না। গত বছর শাওমি আদালতে দায়ের করা একটি মামলায় বলেছিল, ভারতের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা তাদের নির্বাহী কর্মকর্তাদের 'শারীরিকভাবে আঘাত' ও বলপ্রয়োগের হুমকি দিয়েছে; যদিও সংস্থাটি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ডরসি আরও জানান, তুরস্ক ও নাইজেরিয়ার সরকারও একই রকম চাপ সৃষ্টি করেছিল টুইটারের উপর। দুটি দেশই বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন সময়ে টুইটার সীমাবদ্ধ করেছিল তাদের দেশে, যদিও শেষ পর্যন্ত সেসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।
গত বছর ৪৪ বিলিয়ন ডলারে টুইটার কিনে নেন মার্কিন বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক।
চন্দ্রশেখর বলেন, ডরসির অধীনে থাকাবস্থায় টুইটার ও তার টিম বারবার ভারতীয় আইন ভঙ্গ করেছে। যদিও তিনি ইলন মাস্কের নাম নেননি, তবে তিনি জানান যে ২০২২ সালের জুন থেকে টুইটার নিয়ম মেনেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিগ টেক বনাম মোদি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার মন্ত্রীরা একনিষ্ঠ টুইটার ব্যবহারকারী; কিন্তু বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা অধিকারকর্মীরা বলছেন, মোদি প্রশাসন টুইটারের যেসব কন্টেন্ট তাদের কাজের সমালোচনা করছে বলে প্রতীয়মান হয়, সেগুলোর উপর ব্যাপক সেন্সরশিপ আরোপ করে। প্রশাসনের ভাষ্যমতে, ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার জন্য তারা সুনির্দিষ্ট কিছু কন্টেন্ট অপসারণের আদেশ দেয়।
২০২১ সালে মোদি সরকার '#মোদি প্ল্যানিং ফার্মার জেনোসাইড' শীর্ষক 'উস্কানিমূলক' টুইটার হ্যাশট্যাগ এবং কয়েক ডজন অ্যাকাউন্ট 'জরুরি ভিত্তিতে' ব্লক করে দিতে বলে টুইটার কর্তৃপক্ষকে।
সেসময় ভারতে নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে হাজারো কৃষক রাস্তায় নেমে এসেছিল। এ আন্দোলন মোদি সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। পরবর্তীতে সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নেওয়ার পর এ আন্দোলন বন্ধ হয়।
টুইটার প্রাথমিকভাবে সরকারের অনুরোধ মেনে নিলেও পরে 'ন্যায্য প্রমাণের অভাবে' অধিকাংশ অ্যাকাউন্টই ফিরিয়ে দেয়। এর ফলে টুইটারের বিরুদ্ধে আইনি হুমকি দেওয়া হয়।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে পুলিশ ভারতে টুইটারের কার্যালয় পরিদর্শন করে। ক্ষমতাসীন দলের কিছু পোস্টকে টুইটার 'ম্যানিপুলেটেড' বা 'বিকৃত' হিসেবে চিহ্নিত করার সঙ্গে যুক্ত আরেকটি ঘটনার অংশ হিসেবে টুইটারের কার্যালয়ে হানা দেয় পুলিশ। সেসময় টুইটার জানিয়েছিল, তারা তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
সাক্ষাৎকারে জ্যাক ডরসি বলেন, ভারতে কৃষক আন্দোলনের সময় যেসব কন্টেন্ট সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল, তার বেশিরভাগই ছিল 'নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিককে কেন্দ্র করে, যারা কিনা সরকারের সমালোচনা করেছিলেন'।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এবছর মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৬১তম। এটি দেশটির এযাবতকালের সর্বনিম্ন অবস্থান।