রুশ নাগরিকত্বের আশায় রাশিয়ার পক্ষে যোগ দিচ্ছেন নেপালের বেকার তরুণেরা!
নেপালের নাগরিকদের অনেকেই রাশিয়ান মার্সেনারি বাহিনী 'ওয়াগনার গ্রপ'-এ ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে যোগদান করছেন। মূলত বিদেশি যোদ্ধাদের জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাগরিকত্ব প্রদানের ঘোষণায় প্রলুব্ধ হয়ে তারা এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
ওয়াগনার গ্রুপে যোগ দেওয়া নেপালের নাগরিকদের অনেকেই আবার দেশটির সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। যদিও যুদ্ধে যোগদানের বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে নেপাল সরকারের এ সংক্রান্ত কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা আলোচনা হয়নি।
অন্যদিকে মস্কোতে অবস্থিত নেপাল দূতাবাসের পক্ষ থেকে এর সঙ্গে সরকারের কোনোপ্রকার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নাকচ করা হয়েছে। দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নেপালের তরুণেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওয়াগনার গ্রুপে যোগ দিচ্ছেন।
চলতি বছরের ১৬ মে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বিদেশি যোদ্ধাদের রুশ নাগরিকত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ডিক্রি জারি করেন। তার ফলে বর্তমানে কয়েক ডজন নেপালি তরুণ মার্সেনারি বাহিনী ওয়াগনারের পক্ষ হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
শুধু বিদেশি যোদ্ধাই নয়, বরং তাদের পরিবারের সদস্যরাও রুশ নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ পাবেন। আর এর ফলেই প্রায় ১১ দশমিক ১২ শতাংশ বেকারত্ব থাকা নেপালের তরুণের রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকছেন।
এ বিষয়ে নেপালের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বিনোজ বাসনিয়াত বলেন, "এটা খুবই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো ঘটনা। কিন্তু এতে নেপাল সরকারের কিছু করার নেই। কেননা এ তরুণেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওয়াগনার বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন।"
মেজর জেনারেল বিনোজ বাসনিয়াত আরও বলেন, "যদি নেপালের নাগরিকেরা একটি অন্য সার্বভৌম দেশের সামরিক বাহিনীর অংশ হতে চায়, তবে এটি নেপাল সরকারের বৈদেশিক নীতির অংশ হতে হবে। অথবা দেশটির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছুই করা হয়নি।"
একইসঙ্গে নেপাল সরকারকে নাগরিকদের রুশ বাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি অতি দ্রুত আমলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এ সেনা কর্মকর্তা।
অন্যদিকে গত কয়েক সপ্তাহজুড়ে টিকটক, টেলিগ্রাম ও ইউটিউবসহ নানা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নেপালের তরুণদের রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগদানের ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, নেপালের তরুণেরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কিংবা প্রশিক্ষণস্থলে যাওয়ার জন্য রওনা দিচ্ছেন। কিছু ভিডিও এই তরুণেরা নিজেরাই রেকর্ড করেছে। আবার বাকি ভিডিওগুলো অন্যরা রেকর্ড করেছেন।
যুদ্ধ করতে যাওয়া এমনি একজন নেপালি তরুণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে নেপালের গণমাধ্যম। তিনি দেশটির কোশি প্রদেশের বাসিন্দা এবং রাশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করতে গিয়েছিলেন।
শিক্ষার্থীটির রাশিয়ান ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে ছিল। সেক্ষেত্রে তার কাছে দুটি পথ খোলা ছিল বলে গণমাধ্যমকে জানান এ শিক্ষার্থী।
প্রথমত, ভিসার মেয়াদ শেষের পর নেপালে ফিরে এসে বেকার অবস্থায় থাকা। অথবা রাশিয়ান সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগদান করা। এই শিক্ষার্থী দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছেন।
এর আগে অবশ্য নেপালের নাগরিকদের ফরাসি বাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছা দেখা গিয়েছে। তবে ইউরোপের অন্য দেশের চেয়ে রাশিয়ার প্রবেশ অপেক্ষাকৃত সহজতর। সেক্ষেত্রে শারীরিকভাবে ভালো সক্ষমতার অধিকারী নেপালের তরুণেরা খুব সহজেই রুশ মার্সেনারি বাহিনীতে যোগদান করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রুশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া নেপালের ঐ তরুণ বলেন, "আমাদের আধুনিক অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দিনভর আমাদের এ প্রশিক্ষণ চলেছে; এমনকি কখনো কখনো রাতের বেলাতেও।"
নেপালের কোশি প্রদেশের এ তরুণ আরও বলেন, "প্রশিক্ষণ চলাকালীনই আমাদেরকে ইনস্যুরেন্স সুবিধাসহ ১৫ হাজার নেপালি রূপি বেতন হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এক বছর পর নাগরিকত্বও প্রদান করা হবে। যদি এই এক বছর বেঁচে থাকি, তবে আমি রাশিয়াতেই থাকতে পারব।"
অন্যদিকে নেপালের কর্নালি প্রদেশের এক তরুণ দেশটির সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে রুশ মার্সেনারি গ্রুপে যোগদান করেছেন। নিজ দেশের সেনাবাহিনীতে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণ তার নিয়োগে সহায়তা করেছে।
এ সম্পর্কে কর্নালি প্রদেশের ঐ তরুণ বলেন, "আমরা নেপালের মতো পাহাড়ে ঘেরা একটি এলাকায় আছি। আমি এখানে তিনজন নেপালি বন্ধুসহ মোট ২০০ জন বিদেশির সঙ্গে আছি। আমরা ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগদানের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু এটা বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এছাড়া ইউরোপে প্রবেশ করাও বেশ কঠিন। অন্যদিকে রাশিয়ায় প্রবেশ সহজ।"
সৈন্য হিসেবে যোগদানের ক্ষেত্রে ওয়াগনার গ্রুপের পক্ষ থেকে রুশ ভাষা জানার বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে। শুধু ইংরেজি ভাষা জানলেই মার্সেনারি গ্রুপটিতে যোগদান সম্ভব হচ্ছে।
অন্যদিকে মেজর জেনারেল বাসনিয়াত নেপালের তরুণদের হতাশার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, "শিক্ষাজীবন শেষের পর বহু তরুণ চাকরি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশের পক্ষ থেকে তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা যাচ্ছে না। তাই বহু তরুণ চাকরির খোঁজে দেশ ছাড়ছে; দেশের বাইরে চাকরির সুযোগ বাড়ছে।"
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নেপালের মোট জনসংখ্যার ৬৩.৭ ভাগের বয়স ৩০-এর নিচে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৯ দশমিক ২ ভাগ। ধারণা করা হচ্ছে যে, দেশটিতে চার লাখ তরুণ প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করে।
অন্যদিকে নেপালে চাকরির যে সুযোগ রয়েছে, সার্বিকভাবে সেগুলোর অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। কম বেতন ও কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূল অবস্থা তরুণদের দেশের বাইরে চলে যেতে উৎসাহিত করছে।
এছাড়া নেপালিরা যোদ্ধা জাতি হিসেবে বেশ পরিচিত। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেপালের সেনাবাহিনী অপেক্ষা প্রায় আড়াই গুণ বেশি বেতনে তরুণদের চাকরির সুযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে নেপালের তরুণদের জন্য ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর নাগরিকত্ব গ্রহণ থেকে শুরু করে পেনশনের সুবিধাও রাখা হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে 'গোর্খা রেজিমেন্ট' ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর 'ব্রিগেড অব গোর্খা' তাদের সাহসিকতা এবং শক্তিমত্তার জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত। ১৮১৫ সাল থেকে তাদেরকে এসব সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রতিবছর নেপালের বিখ্যাত গোর্খা জনগোষ্ঠী থেকে প্রায় ১,৩০০ জন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করত। তবে চলতি বছর একজন গোর্খাও ভারতীয় বাহিনীতে যোগ দেয়নি।
কেননা নেপালের কমিউনিস্ট সরকার গোর্খাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদানের অনুমতি বাতিল করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রুশ মার্সেনারি বাহিনী 'ওয়াগনার গ্রুপ'-এ গোর্খাসহ নেপালি তরুণদের যোগদানের প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেকে।