কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে ভীত নন বিল গেটস, কিন্তু কেন?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সম্পর্কিত ঝুঁকির প্রশ্নে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে চলেছেন প্রযুক্তি বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা; এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মার্কিন বিলিয়নিয়ার বিল গেটস। সম্প্রতি গেটস জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি খুব একটা চিন্তিত নন।
এই প্রযুক্তি নিয়ে বিপদের আশঙ্কা ও প্রচুর সতর্কবার্তা শোনার পর এবার যখন আশার বাণী শোনাচ্ছেন গেটস, তখন নতুন কিছু আইডিয়াও যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে।
মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও মানবহিতৈষী বিল গেটস তার ব্যক্তিগত ব্লগ গেটসনোটস-এ দুদিন আগেই এআই নিয়ে কথা বলেছেন। গেটস লিখেছেন, "আমি স্বীকার করছি যে প্রায়ই এআই নিয়ে উদ্বেগের কথা শুনছি ও পড়ছি এবং এর মধ্যে অনেকগুলো আমার মধ্যেও কাজ করে। তবে আমি নিজে এ সম্পর্কে কি ভাবি তা ব্যাখ্যা করতে চাই।"
এই বিলিয়নিয়ার বিজনেস ম্যাগনেটের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই 'আমাদের জীবদ্দশায় দেখা সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন সৃষ্টিকারী একটি প্রযুক্তি।' তার মানে তিনি এটিকে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, এবং পারসোনাল কম্পিউটারেরও উপরে রেখেছেন- আর গেটস নিজেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারসোনাল কম্পিউটার সফটওয়্যার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। (এটি আরও আভাস দেয় যে আগামী কয়েক দশকেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে পেছনে ফেলার মতো কোনোকিছু উদ্ভাবিত হবে না।)
কয়েক সপ্তাহ আগে এআই সেফটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংক্রান্ত নিরাপত্তা ইস্যুগুলো নিয়ে সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক 'সেন্টার ফর এআই সেফটি'র প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বিল গেটসসহ বিশ্বের কয়েক ডজন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তি। এই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, "মহামারি এবং পারমাণবিক যুদ্ধের মতো অন্যান্য 'সোশ্যাইটাল-স্কেল' ঝুঁকির পাশাপাশি এআইয়ের কারণে মানব বিলুপ্তির ঝুঁকি হ্রাস করাও অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত।"
কিন্তু দুদিন আগে বিল গেটসের ব্লগ পোস্টে সেরকম কোনো উদ্বেগজনক বার্তা নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের জায়গা নেবে এমন আশঙ্কার দিকে নজর দেননি তিনি এই পোস্টে। বরং বিল গেটস এআই'র তাৎক্ষণিক ঝুঁকির তুলনায় এই বিতর্ককে 'দীর্ঘমেয়াদি' চিন্তা বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, আমাদের উচিত 'ইতোমধ্যেই যেসব ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বা শীঘ্রই হবে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া।'
এক দশক আগে যখন ডিপ লার্নিং প্রযুক্তির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়েছিল বিশ্ব, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি মানবঅস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে ওঠার বিষয়টি নিয়ে যারা কথা বলেছিলেন, বিল গেটস ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। যুক্তরাজ্যে অ্যালান টুরিং ইনস্টিটিউটের এথিকস অ্যান্ড রেসপন্সিবল রিসার্চ-এর পরিচালক ডেভিড লেসলি বলেন, "ঐ সময় তিনি (বিল গেটস) সুপারইন্টেলিজেন্স নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। এখন মনে হচ্ছে তার সেই চিন্তা কিছুটা কমে এসেছে।"
যদিও বিল গেটস এআই'র ফলে বিলুপ্তির ঝুঁকি পুরোপুরি নাকচ করেননি; কিন্তু তিনি ভাবছেন- 'যেকোনো বিষয় বা কাজ শিখতে পারে এমন এআই উদ্ভাবিত হলে কি ঘটবে?' যেটিকে প্রায়ই আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা এজিআই বলে অভিহিত করা হয়।
বিল গেটস লিখেছেন, "আগামী এক দশক বা এক শতকের মধ্যেই হোক, আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবো যখন সমাজকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। সুপার এআই যদি নিজেই একটা লক্ষ্য ঠিক করে তখন কি হবে? এআই'র সেই লক্ষ্য যদি মানবজাতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তখন কি হবে? আমাদের কি আদৌ সুপার এআই তৈরি করা উচিত? কিন্তু এসব দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির কথা চিন্তা করে সাম্প্রতিক ঝুঁকিগুলোকে অবহেলা করলে চলবে না।"
ডিপ-লার্নিং এর পথিকৃত জিওফ্রে হিন্টন গুগল ছেড়ে দিয়েছেন এবং গত মে মাসে এআই সম্পর্কে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন; অন্যদিকে রয়েছেন মেটা এআই'র ইয়ান লিকান এবং জোয়েল পিনাউয়ের মতো ব্যক্তিরা, যারা মনে করেন এআই'র কারণে 'মানব বিলুপ্তির ঝুঁকি' খুবই 'অযৌক্তিক ও হাস্যকর' প্রসঙ্গ। অথবা সিগনাল-এ কর্মরত মেরেডিথ হুইটেকার- যিনি ভাবেন হিনটন ও অন্যরা যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেগুলো স্রেফ 'কাল্পনিক গল্প'।কিন্তু গেটস এক প্রকার মাঝামাঝি অবস্থানে রেখেছেন নিজেকে।
তবে এবার এআই নিয়ে মতামত দেওয়ার পর বিল গেটস নিজে কি অবদান রাখবেন সেটাই প্রশ্নের বিষয়, বলেন লেসলি। তার ভাষ্যে, "সবাই এই ইস্যুতে কথা বলছে, তাই সবাই বিষয়টার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে।"
বিল গেটসের মতো লেসলিও এআই'র কারণে ধ্বংসাত্বক ফলাফলের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি নাকচ করে দেননি। তিনি বলেন, "খারাপ মানুষেরা এই প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে আমাদের জন্য বিপর্যয়কর ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। কিন্তু আমি এ বিষয়ে একমত যে, আপাতত আমাদের চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত জেনারেটিভ এআই'র দ্রুত বাণিজ্যিকীকরণের ফলে বর্তমানে যেসব ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা নিয়ে কাজ করা। এখন আমাদের বুঝতে হবে যে তাৎক্ষণিক ঝুঁকিগুলো কি কি?"
বিল গেটস তার ব্লগের পোস্টে লিখেছেন, নির্বাচন থেকে শুরু করে শিক্ষা এবং চাকরি, এআই ইতোমধ্যেই সমাজের মৌলিক কিছু ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেটস আমাদের যা বলতে চান তা হলো- 'যদিও এই হুমকিগুলো গুরুতর, কিন্তু আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পারব এই বিশ্বাস রাখার কারণ হচ্ছে আমরা এর আগেও তা পেরেছি'।
সত্তর ও আশির দশকে ক্যালকুলেটর শিক্ষার্থীদের গণিত শেখার প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। ১৯৮০ ও ৯০'র দশকে ওয়ার্ড প্রসেসিং এবং স্প্রেডশিট অ্যাপ্লিকেশনগুলো অফিসের কাজের ধরনই বদলে দেয়- আর এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছিল বিল গেটসের নিজের কোম্পানি মাইক্রোসফট।
আবারও গেটস পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখেন যে কিভাবে মানুষ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল এবং এই বিলিয়নিয়ারের দাবি- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও মানুষ তা করতে সক্ষম হবে।"ওয়ার্ড প্রসেসিং অ্যাপগুলো কিন্তু অফিসের ওইসব কাজের সমাপ্তি ঘটায়নি, কিন্তু কাজের ধরন বদলে দিয়েছে। এআই'র ফলে সৃষ্ট পরিবর্তনের পথ আমাদের জন্য মসৃণ হবে না, কিন্তু মানুষের জীবন ও জীবিকায় যেসব বাধাবিঘ্ন ও জটিলতা তৈরি করেছে এটি, তা যে আমরা প্রশমিত করতে পারবো এমনটা বিশ্বাস করারও যৌক্তিক কারণ রয়েছে", বলেন গেটস।
এবার তথ্য বিকৃতি বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রসঙ্গে আসা যাক। গেটস বলছেন, আমরা ইতোমধ্যেই জানি কিভাবে অপ্রাসঙ্গিক বা অযাচিত তথ্য ছড়ানো রোধ করা যায়, তাই ডিপফেইকের ক্ষেত্রেও আমরা তেমনই পদক্ষেপ নিতে পারবো। গেটস লিখেছেন, "প্রতারণামূলক কাজ যেমন বেড়ে গিয়েছে এবং সুনিপুণভাবে করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তেমনই প্রতারকদের টার্গেট যারা, তারাও আগের চেয়ে সচেতন হচ্ছেন। ডিপফেইক এর ক্ষেত্রেও আমাদের একই রকম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।"
গেটসে তালিকায় যেসব ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি, সেগুলো প্রতিরোধ করতে দ্রুত কিন্তু সাবধানতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, তিনি নতুন কিছু বলছেন না। তার দেওয়া অনেক পরামর্শই পুরনো, কিছু কিছু পরামর্শ অতি সহজ- মূল জটিলতা দূর করতে যা প্রযোজ্য নয়।
বিগত কয়েক সপ্তাহে অন্যদের মতো বিল গেটসও এআই'কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মতো একটি বৈশ্বিক সংস্থা তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এআই সাইবারওয়েপন এর বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করতে এটা একটা ভালো উপায়। কিন্তু তাদের আইনের মাধ্যমে কি নিয়ন্ত্রণ করবে বা কিভাবে প্রয়োগ করা হবে তা তিনি বলেননি।
বিল গেটস আরও বলেছেন, সরকার এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর এ বিষয়ে সহায়তা দিতে হবে যেন চাকরির বাজারে কেউ পিছিয়ে না থেকে যায়। বর্তমান বিশ্বে চ্যাটজিপিটি যেভাবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, এমতাবস্থায় শিক্ষকদেরও সহায়তার আওতায় আনতে হবে। কিন্তু এই সহায়তাগুলো কেমন হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি বিল গেটস।
আর তিনি বলেছেন, ডিপফেইক শনাক্ত করার ক্ষমতা থাকতে হবে আমাদের মধ্যে, অথবা টুলস ব্যবহার করতে হবে এগুলো শনাক্ত করার জন্য। কিন্তু সর্বশেষ যে টুল উদ্ভাবিত হয়েছে সেটি এআই-জেনারেটেড ছবি বা টেক্সট শনাক্তের জন্য অতটা কার্যকরী নয়। জেনারেটিভ এআই যেভাবে বিকাশ লাভ করছে, এই টুলসগুলো কি তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পেরে উঠবে?
তবে জনসাধারণ এই প্রযুক্তি সম্পর্কে, এর উপকারিতা ও ঝুকিগুলো সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল, তা নিয়ে একটা ভালো আলোচনা হতে পারে বলে জানিয়েছেন গেটস। কিন্তু তিনি প্রায়ই এমন প্রত্যয় প্রকাশ করেন যে এআই'র সমস্যাগুলো এআই-ই সমাধান করবে; যদিও সবাই তার এই বিশ্বাসের সাথে একমত নন।
হ্যাঁ, আমাদের অবশ্যই তাৎক্ষণিক বা বর্তমান ঝুঁকি নিরসনে কাজ করতে হবে। হ্যাঁ, আমরা আগেপরেও প্রযুক্তিগত উত্থা-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছি এবং এবারও তা মোকাবিলা করতে পারবো। কিন্তু সেটা কিভাবে?
বিল গেটস নিজেই লিখেছেন, "এআই'র ঝুঁকির বিষয়ে এখন পর্যন্ত যে যা লিখেছেন তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, কারো কাছেই সব প্রশ্নের সদুত্তর নেই।"