কারাগারে ইমরান খান, তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি শেষ?
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গত কয়েক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে পূর্ববর্তী ৯ মে এর গ্রেপ্তারের তুলনায় সাম্প্রতিক গত ৫ আগস্টের গ্রেপ্তারটি অনেক দিক থেকেই ব্যতিক্রম। খবর বিবিসির।
গত মে মাসে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর পুরো পাকিস্তানজুড়ে শুরু হয় ব্যাপক প্রতিবাদ। এমনকি গাড়ি-বাড়ি ও সেনাবাহিনীর স্থাপনায় হামলার মতো ঘটনা ঘটে।
তবে চলতি মাসে ইমরানকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আগের মতো প্রতিক্রিয়া নেই। বরং বাকিসব সাধারণ দিনের মতোই দেশটিতে পরবর্তী দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে।
বর্তমানে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির নেতা ইমরান খান কারাগারেই রয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি হিসেবে পাওয়া উপহার বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই কারাদণ্ডের ফলে আগামী নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করার যোগ্যতাও হারিয়েছেন।
গ্রেপ্তারের পূর্বে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ইমরান জনগণকে ঘরে বসে না থেকে বরং শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই আহ্বান মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হয়নি।
এ সম্পর্কে বর্তমানের সরকারের মন্ত্রীরা মনে করেন, জনগণ ইমরান খান কিংবা তার দলের অনুগত হতে চাচ্ছে না। কেননা তারা পূর্বে প্রতিবাদের নামে সহিংসতা করেছে। অন্যদিকে ইমরানের সমর্থকেরা অবশ্য এমনটা মনে করেন না।
পাকিস্তানে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সেনাবাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সাথে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ইমরান খানের তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের একটা অংশ মনে করেন যে, ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে ইমরান অবশ্য এ সকল গোষ্ঠীর সমর্থন ও সাহায্য নিয়েছিল। তবে ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে সেই মধুর সম্পর্ক তিক্ততায় রুপ নিয়েছে।
ঠিক তখন থেকেই ইমরান খান আগামী নির্বাচনের জন্য চুপচাপ বসে না থেকে বরং সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের ক্রমাগত সমালোচনা করেছেন। মে মাসে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর গ্রেপ্তারের পর সেনাবাহিনীর নানা স্থাপনায় বিক্ষুব্ধ সমর্থকদের হামলার বিষয়টিও তারা খুব নেতিবাচকভাবে দেখেছে।
যার ফলশ্রুতিতে তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) কর্মীদের ওপর সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দলের হাজার হাজার সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অনেককেই মিলিটারি আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। যদিও মানবধিকার সংস্থাগুলো মনে করে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এমন পদক্ষেপ নিজ দেশের সাধারণ জনগণের ওপর প্রয়োগ করা যুক্তিযুক্ত নয়।
এদিকে পাকিস্তানের গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত মে মাসের শেষ দিকে টেলিভিশন মালিকেরা সেনাবাহিনীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এরপর থেকে দেশটির গণমাধ্যম থেকে অনেকটা উধাও ইমরান খান। সূত্র মতে, গণমাধ্যমে ইমরানের নাম, ছবি ইত্যাদির ব্যবহারে অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা আনা হয়েছে।
অন্যদিকে ইমরান খানের সমর্থকেরা জানান, তারা নিজেদেরকে বাঁচাতে ইমরানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা বন্ধ করেছে। একইসাথে পূর্ববর্তী পোস্ট মুছে ফেলা থেকে শুরু করে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জনপরিসরে দেখা থেকেও বহু সমর্থক নিজেকে বিরত রেখেছেন। তাদের আশঙ্কা এই যে, সবাইকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে এবং ইমরানের খানের সাথে সংশ্লিষ্টতা পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করা ইমরান সমর্থকদের তারা গ্রেপ্তার করছে না। তবে বিবিসি উর্দুর সাংবাদিকরা জানান, গত শনিবার ইমরানের বাসার সামনে হাজির হওয়া সমর্থকদের পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। তবে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি-না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র বিবিসিকে জানায়, পুলিশের পক্ষ থেকে প্রায় ১০০ পিটিআই সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একইসাথে ইমরান খানের সমর্থকেরা যাতে জড়ো হতে না পারে সেই সম্পর্কেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে পুলিশকে বলা হয়েছে।
এ সম্পর্কে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক দ্য সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, "আমি মনে করি শাসকদের কঠোর দমন-পীড়নের ফলে ইমরান সমর্থকেরা নিজেদের অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। তারা গত ৯ মে এর মতো আরও একবার নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলতে চাইছেন না।"
অন্যদিকে ইমরানের আইনজীবীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন , তারা ইমরানের তিন বছর কারাদণ্ডের রায়ে শীঘ্রই আপিল করবেন।
গত কয়েক মাস ধরে ইমরানের আইনজীবীরা বেশ কয়েকটি মামলা থেকে সাময়িকভাবে ইমরানকে রক্ষা করতে পেরেছিল। তবে এক্ষেত্রে মামলাগুলো থেকে রেহাই নয়; বরং কালক্ষেপণই করা হচ্ছিলো।
পাকিস্থানের ইতিহাসে ইমরান খান একাই নয়, বরং পাকিস্তানের আদালতে সাজার মুখোমুখি হয়েছেন বহু রাজনৈতিক নেতা। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নওয়াজ শরীফ, বেনজির ভুট্টো ও সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
এমনকি ইমরান খান নিজেও যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মীকে নানা মামলায় জেলে কাটাতে হয়েছিল। এছাড়াও পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা বিরোধী পক্ষে থাকা অবস্থায় প্রায়শই অভিযোগ করেন যে, দেশটির বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইমরান খান যদি শেষমেশ নির্বাচনে অংশ না-ই নিতে পারেন, তবে বড় শঙ্কার বিষয় এই যে, পিটিআইয়ের ভবিষ্যৎ ঠিক কী হবে।
যদিও ইমরান খান আগেই বলেছিলেন, তিনি নির্বাচনে জিতলে বা না জিতলেও পিটিআই টিকে থাকবে এবং উন্নতি করবে।
এ সম্পর্কে কুগেলম্যান বলেন, "এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, নির্বাচন উপলক্ষে পিটিআইয়ের বাকি নেতারা নিজেদের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালনা করবেন। তারা কি দলের সমর্থকদের রাস্তায় আনতে পারবেন? তারা কি সফল হবেন? এটাই এখন সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে।"
রাজনৈতিক দল হিসেবে পিটিআই ইমরান খানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। এমনকি ভোটের ব্যালটে দলটির দলীয় প্রতীক হচ্ছে ব্যাট; যা ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে ইমরানের পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক ক্যারিয়ারের স্মারক।
চলতি বছরের শুরুতে দেশটির সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই ইমরানকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা পিটিআই ছেড়ে দিয়েছেন।
পিটিআইয়ের সাথে যুক্ত বাকি নেতাকর্মীদের সিংহভাগই আত্মগোপনের রয়েছেন; গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। এমতবস্থায় প্রায় সকলেই মনে করেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে পিটিআইয়ের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে যাবে।