বেহাত হওয়া ভূমি পুনর্দখলের সুযোগ ফুরিয়ে আসছে ইউক্রেনের
বড় যুদ্ধ যেমন হয়– যেখানে পরাশক্তিগুলোর মর্যাদা, বৈশ্বিক অবস্থান জড়িয়ে পড়ে – তেমনই এক মরণপণ লড়াই দেখা যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে। দখলীকৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে এখন কাউন্টার-অফেন্সিভ বা পাল্টা-আক্রমণ অভিযান চালাচ্ছে ইউক্রেন। যদিও এর মাধ্যমে বেহাত হওয়া ভূমি পুনর্দখলের সুযোগ কমছে তাদের।
দুই মাসের বেশি সময় ধরে কাউন্টার-অফেন্সিভের লড়াই চলার পর এখন তা মুখ থুবড়ে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিয়েভের সেনারা গুটিকয় গ্রামই দখল করতে পেরেছে এ অভিযানে, একইসময় উত্তরদিকে অগ্রসর হচ্ছে রুশ সেনারা। এরমধ্যে ইউক্রেনীয় পাইলটদের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পরিচালনায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনাও পেছানো হয়েছে।
শেষোক্ত ঘটনার পেছনেও যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি দায়ী। রণাঙ্গনে ইউক্রেনীয় বাহিনীর নিশ্চিত সাফল্য লাভের ব্যর্থতা স্পষ্ট হতে থাকায় ভয় পাচ্ছে পশ্চিমারা। এতে আন্তর্জাতিক মিত্রদের সহায়তা কমতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। এফ-১৬ বিমানে প্রশিক্ষণ পেছানো হয়তো তারই ইঙ্গিত।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক এক গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, কাউন্টার-অফেন্সিভের প্রধান লক্ষ্য দক্ষিণপূর্বের মেলিটোপোল শহর পর্যন্ত এগোতে ব্যর্থ হবে ইউক্রেনীয় বাহিনী।
এদিকে যুদ্ধক্লান্ত ইউক্রেনীয়রা কিয়েভ প্রশাসনের থেকে জয়ের সংবাদ পেতে অধীর হয়ে উঠছে। এরমধ্যে ওয়াশিংটনে ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তা কমানোর দাবি উঠছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে এ দাবি আরো জোরালো হয়ে উঠবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
সমর বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্মুখসারিকে শক্তিশালী করতে আরো অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং রিজার্ভে থাকা সমস্ত সুপ্রশিক্ষিত সেনা ইউনিটগুলোকে মোতায়েন করা ছাড়া – ইউক্রেন এই অভিযানের মাধ্যমে শত্রুব্যুহভেদ করতে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এবং সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির জ্যেষ্ঠ ফেলো ফ্রাঞ্জ- স্তেফান গেডি। গত জুলাই মাসে তিনি ইউক্রেন সফর করেন। তিনি বলছেন, 'বিবাদমান কোন পক্ষ আগে দুর্বল হয়ে পড়বে – সেটাই এখন প্রশ্ন। রাতারাতি কোনো বড় সামরিক অর্জনের আশা রাখা উচিত হবে না আমাদের।'
গেডি বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই বর্তমানে শক্তিক্ষয়ের পর্যায়ে আছে, উল্লেখযোগ্য ভূমি দখলের চেষ্টার বদলে তারা একে-অন্যের সম্পদ ধবংসের চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজ সেনাদের অগ্রগতি সার্বিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ায়– রাশিয়ার ভূখণ্ডে বারবার ড্রোন হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেন। যদিও তাতে সামান্যই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ার।
কাউন্টার-অফেন্সিভের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংকোচ করছেন পশ্চিমা ও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। তারা ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলছেন, লড়াই প্রত্যাশার চেয়ে ধীর গতিতে এগোচ্ছে। তবে পর্যায়ক্রমে সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে বলেও তারা দাবি করছেন।
কিন্তু, অনন্তকাল সময় নেই ইউক্রেনের। শরৎকাল আসন্ন, যখন ভালো পরিমাণে বৃষ্টি হয় দেশটিতে। এসময় কাদার দৌরাত্মে সামরিক অভিযানের গতি আরো মুখ থুবড়ে পড়ে। আগামী দুই সপ্তাহ তাই শেষ সুযোগ। শরত ঋতুর কারণেই গেল বছরের নভেম্বরে খেরসন শহর পুনর্দখলের পর খুব একটা এগোতে পারেনি ইউক্রেনের সেনারা।
স্থলবাহিনীর অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়ায়, ইউক্রেন আরো আধুনিক বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও শক্তিশালী যুদ্ধবিমান পাওয়ার অপেক্ষা করছে। আর হামলার পরিধি বিস্তারের জন্য বাড়িয়েছে ড্রোন স্ট্রাইক। এমনটাই জানান ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ইউরি সাক।
তিনি বলেন, 'আমরা এখনও এফ-১৬ বিমান পাইনি। বিমানশক্তির এই ঘাটতি আমরা ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টা করছি।'
শুধু আকাশপথেই নয়, জলচর ড্রোন দিয়েও হামলা করছে ইউক্রেন। সম্প্রতি রাশিয়ার একটি প্রধান বন্দর নভোরুসিস্কে, এবং ক্রিমিয়ার কাছে একটি জ্বালানি তেলবাহী রুশ জাহাজে ড্রোন দিয়ে আক্রমণ করা হয়। এসব অভিযান, ইউক্রেনের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালনা করছে বলে নাম না প্রকাশের শর্তে ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছেন দেশটির এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ড্রোন হামলার মাধ্যমে মন্থর হয়ে পড়া অভিযান থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে চাইছে ইউক্রেন। সে চেষ্টায় তারা কিছুটা সফল হলেও– এতে যুদ্ধের মোড় কিয়েভের পক্ষে ফিরবে না।
মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বব হ্যামিলটন– বর্তমানে চিন্তক সংস্থা ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের গবেষণা প্রধান হিসেবে যুক্ত আছেন।
তার মতে, 'রাশিয়ার অনেক ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মতো যথেষ্ট পরিমাণ ড্রোন তৈরির সক্ষমতা নেই ইউক্রেনের। ফলে বিচ্ছিন্ন কিছু হামলা চালিয়ে তারা রুশদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মনোবল ভাঙ্গতে পারবে না।'
তাছাড়া, ইউক্রেনের ড্রোন প্রতিরোধে রাশিয়ার আছে অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম। বিশেষত রাশিয়ার ইলেকট্রনিক জ্যামার এক্ষেত্রে ভালো সফলতা পাচ্ছে। গত সপ্তাহে ইউক্রেনের বেশকিছু ড্রোন স্ট্রাইক ব্যর্থ করে দেওয়ার দাবি করেছে ক্রেমলিন।
শনিবার (১৯ আগস্ট) রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ক্রিমিয়াকে টার্গেট করা আরো ২০টি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে।
স্তেফান গেডি বলেন, সম্মুখসারি থেকে অনেক পেছনে থাকা রুশ সেনাবাহিনীর রসদ ও পরিবহন ব্যবস্থাতেও দূরপাল্লার হামলা করছে ইউক্রেন। কিন্তু, গত কয়েক মাসে এসব হামলার ফলে রুশ বাহিনীর শক্তি বা সামর্থ্য কমতে দেখা যায়নি।
'আমরা জানি রুশদের অবস্থার অবনতি হয়েছে, কিন্তু (আক্রমণের মুখে) আকস্মিকভাবে ভেঙে পড়বে এমন অবনতি সেটা নয়। ডিপ ব্যাটেল বলে পরিচিত এই যুদ্ধ কৌশল তখনই সফল হয়, যখন লজিস্টিকস ব্যবস্থার প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির ফলে শত্রু বাহিনী আর রিজার্ভ সেনাদের ফ্রন্টে আনতে পারে না, বা নিয়মিত রসদ সরবরাহও করতে পারে না।'
সে তুলনায়, ভেঙে পড়া দূর– রুশ বাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, এমনকী তারা এগিয়ে এসে আক্রমণও চালাচ্ছে। রুশদের এগিয়ে আসার কারণে কুপিয়ানস্ক থেকে নাগরিকদের গণহারে সরিয়ে নিতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে। গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে অভিযান চালিয়ে এই শহরসহ বিপুল এলাকা পুনরুদ্ধার করেছিল ইউক্রেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা দ্রুত আক্রমণের পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু, দক্ষিণ ফ্রন্টে অনেক সংগ্রাম করে প্রতি ইঞ্চি এগুতে হচ্ছে কিয়েভের বাহিনীকে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে নতুন কোনো এলাকা দখলে ব্যর্থতার পর গত মাসে স্টারোমাইরোস্ক গ্রাম দখল করে ইউক্রেনীয় সেনারা। তখন পশ্চিমা প্রশিক্ষণ পাওয়া সেনাদের দিয়ে তুমুল অগ্রগতির আশা জেগেছিল। কিন্তু, তা উবে যায় অচিরেই। কারণ, এরপর পাশের গ্রাম উরোঝাইনি মুক্ত করতেই আরো তিন সপ্তাহ সময় নেয় তারা। এই লড়াইয়ে তাদের বিপুল সংখ্যক হতাহত হওয়ার খবরও জানা গেছে।
ইউক্রেনের সেনারা আজভ সাগরতীরে পৌঁছানোর মাধ্যমে রুশ বাহিনীকে ক্রিমিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করবে– এটা ছিল কাউন্টার-অফেন্সিভের ঘোষিত লক্ষ্য। কিন্তু, স্টারোমাইরোস্ক গ্রাম দখলের লড়াইয়ে নতুন কৌশলের ব্যবহার দেখা যায়নি। গতানুগতিকভাবেই চলেছে এই লড়াই। প্রথমে নজরদারি ইউনিটগুলো রাশিয়ান প্রতিরক্ষাগুলো সম্পর্কে জরিপ নেয়, এরপর ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ হয়ে, মাইন ধবংসকারী টিমের সহায়তায় পায়ে হেঁটে সামনে এগোয়।
ওই অঞ্চলের জন্য ইউক্রেনীয় বাহিনীর মুখপাত্র সেরহি কুজমিনই দিয়েছেন এই বর্ণনা।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা ইউরি সাক বলেছেন, সম্মুখভাগজুড়ে বিস্তীর্ণ মাইনফিল্ডের কারণে পশ্চিমা কৌশলে প্রশিক্ষিত বেশিরভাগ সেনা ইউনিটকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, 'আমাদের এসব রিজার্ভ বাহিনীকে মোতায়েনের আগে সামনের পথ পরিষ্কার থাকা দরকার। তাই সেনাদের জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনে আমরা ধীরে এগোব।'
অভিযান শুরুর পর থেকে ইউক্রেন মাত্র ৮১ বর্গমাইল এলাকা পুনর্দখল করতে পেরেছে। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে বাখমুতে্র কাছে এবং দক্ষিণে ঝাপোরিঝিয়া অঞ্চলে ওরিখিভের কাছে।
এই অবস্থায় সাধারণ রাশিয়ান নাগরিকদের যুদ্ধের মূল্য বোঝাতে ইউক্রেন রাশিয়ার ভেতর হামলার পরিমাণ বাড়িয়েছে। কিন্তু, নিজেদের প্রস্তুত করা ড্রোন দিয়েই এসব হামলা চালাতে হচ্ছে কিয়েভকে। কারণ, রাশিয়ার ভেতরে হামলার জন্য ন্যাটো সদস্যদের দেওয়া অস্ত্র ব্যবহারে বিধিনিষেধ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো– এই যুদ্ধকে সরাসরি নিজেদের ঘাড়ে নিতে চায় না। পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়ানোর পরিণাম সম্পর্কেও তাদের সঙ্গত উদ্বেগ আছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পলিসি গ্রুপ স্টিমসন সেন্টারের সিনিয়র ফেলো এবং বিমানশক্তি গবেষক কেলি গ্রিকো বলেন, কিয়েভকে ধাপে ধাপে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধের ঝুঁকিকে সীমিত রাখতে সফল হয়েছে বাইডেন প্রশাসন। 'যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনের মিত্ররা এ যুদ্ধে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন।'
মার্কিন সেনাবাহিনীর কৌশলগত মিসাইল অ্যাটাকমস কয়েক মাস ধরেই চাইছে কিয়েভ। কিন্তু, এটি তাদের দিতে রাজি হয়নি বাইডেন প্রশাসন। এক্ষেত্রে মিসাইলটির সীমিত সরবরাহ এবং রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির কথাই বলা হয়েছে।
যদিও ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য চলতি বছরের শুরুতে ইউক্রেনকে এ ধরনের মিসাইল দিয়েছে। তবে বাইডেন প্রশাসন বার বার বলে আসছে, তারা রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালানোর মতোন অস্ত্র দেবে না।
অর্থাৎ, রাশিয়ায় হামলা চালানোর শক্তি খুব বেশি নয় ইউক্রেনের। যুক্তরাষ্ট্রই ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় অস্ত্রদাতা। তাদের সহায়তা ছাড়া ড্রোন আক্রমণও খুব বেশিদিন চালাতে পারবে না কিয়েভ। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, পাল্টা আঘাত হানার সব রাস্তাই যেন কিয়েভের জন্য একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।