‘ব্রিকসের দেয়াল’: জোটে নতুন ছয় সদস্যের অন্তর্ভুক্তি যে কারণে তাৎপর্যপূর্ণ
জোটের প্রভাব বিস্তারে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে ব্রিকস। আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে পূর্ণ সদস্য হিসেবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন নিয়ে গঠিত জোটটি প্রথমবার সম্প্রসারিত হয় ২০১০ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেওয়ার পর জোটের নাম ব্রিক থেকে হয় ব্রিকস।
এখন বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও গ্লোবাল সাউথের স্বার্থ রক্ষায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আরো সহযোগিতা বৃদ্ধিতে জোটের সম্প্রসারণ হবে।
চলতি সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে জানা যায়, ৪০টি দেশ জোটে যোগ দিতে আগ্রহী এবং ২৩টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদনও করেছে।
বৃহস্পতিবার সম্মেলনের চূড়ান্ত দিনে গৃহীত দ্বিতীয় জোহানেসবার্গ ঘোষণায় ব্রিকস জানায়, 'জোটের সদস্য হতে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলির দেখানো আগ্রহকে আমরা সাধুবাদ জানাই। ব্রিকস সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার নীতি ও মানদণ্ড নিয়ে ঐক্যমতের পরই ছয়টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।' তবে নির্দিষ্ট মানদণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়নি।
'গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র'
প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব স্কলারশিপের অধ্যাপক ড্যানি ব্র্যাডলো বলেন, আমন্ত্রণ পাওয়া ছয়টি রাষ্ট্র (ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে) গুরুত্বপূর্ণ, এ বিষয়টি ছাড়া দেশগুলোর মধ্যে আর কোন মিল নেই।
আফ্রিকা ও চীন নিয়ে কাজ করা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সানুশা নাইডু বলেন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিশরের অন্তর্ভুক্তির ফলে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, এটি খুব মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। তবে মূলত এখানে ভূ-অর্থনৈতিক, ভূ-কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে।
সানুশা নাইডুর মতে, দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তি ব্রিকসের সদস্যদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য করবে। চীন ও ভারতকে তাদের বর্তমান নীতি জোরদারে অবদান রাখবে।
নতুন সদস্য নির্বাচনে ব্রিকস হয়তো জ্বালানি তেলের দাম, এবং মূল্য কমাতে দেশগুলোর সম্ভাব্য অবদান বিবেচনায় নিয়েছে। নাইডু বলেন, রাশিয়া ছাড়া বর্তমান সব সদস্য জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ নয়। অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া চলমান রাখা প্রয়োজন তাদের। কিন্তু দেশগুলো নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে ভুগতে চায় না।
কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা, বৈশ্বিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের ধারাবাহিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায় ব্রিকস। সেন্টার ফর চায়না এবং গ্লোবালাইজেশন ইন বেইজিং এর সিনিয়র ফেলো কারিন কস্তা ভাসকেজ বলেন, জোটের সম্প্রসারণ বাণিজ্যের নতুন সুযোগ সামনে আনবে।
তিনি বলেন, পরিকল্পিত সম্প্রসারণের পিছনে একটি উদ্দেশ্য হল 'স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করে ব্রিকস দেশগুলি একে অপরের সাথে আরও সহজে বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি করা।' বিষয়টি অন্যান্য মুদ্রার ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অন্তর্ভুক্তি
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের আধিপত্যের বাইরে একটি বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে যে দেশগুলি লাভবান হতে পারে তাদের মধ্যে একটি হল ইরান।
দক্ষিণ আফ্রিকার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মাপুংপওয়ে ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক রিফ্লেকশনের সিনিয়র গবেষক নাঈম জিনাহ বলেন, ইরান স্পষ্টতই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। তিনি বলেন, ইরানের অন্তর্ভুক্তি দেখায় যে, 'যুক্তরাষ্ট্র যতটা চায়, রাজনৈতিকভাবে ততটা বিচ্ছিন্ন নয় দেশটি।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির কারণে দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তি একটি 'অর্থনৈতিক লাইফলাইন' হতে পারে। সদস্যরা তাদের নিজস্ব মুদ্রায় একে অপরের সাথে ব্যবসা শুরু করবে। ইরানের জন্য এটি দুর্দান্ত এক বিষয় হবে, যোগ করেন নাঈম।
তিনি আরো বলেন, জোটে যোগ দেওয়ায় আর্জেন্টিনার সম্ভাবনা সবচেয়ে অনেক বেশি। কারণ চীন, ব্রাজিল এবং ভারতের ইতিবাচক সাড়া ছিল। এ ছাড়া তেলের মজুত থাকা আলজেরিয়া ও আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল এবং নেতৃস্থানীয় অর্থনীতির দেশ নাইজেরিয়া অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা অনুমান করেছিলেন।
পশ্চিম আফ্রিকা নিয়ে কাজ করা এসবিএম ইন্টেলিজেন্সের অংশীদার চেটা নওয়ানজে বলেন, 'একটা বিষয় স্পষ্ট যে, নাইজেরিয়া ও কেনিয়া ছাড়া আফ্রিকার বাকি দেশগুলো পশ্চিমাদের থেকে সরে আসছে এবং পূর্বের দিকে ঝুঁকছে। মূলত পশ্চিমাদের সাথে থেকে কোন সুবিধা না পেয়েই এমনটা হচ্ছে।' নাইজেরিয়া অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণ হিসেবে তাদের পশ্চিমা ঘেষা পররাষ্ট্রনীতি বলে মত দেন তিনি।
ইথিওপিয়ার অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে নাঈম জিনাহ বলেন, দেশটি দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোক একটি। এছাড়া আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তরও সেখানে।
আর সৌদি আরব, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পররাষ্ট্র নীতিতে অনেকটা ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো। বলা যায়, এক পা পশ্চিমে তো আরেক পা ব্রিকসে।
তবে বিশেষ করে সৌদি আরব এখন আর ততটা যুক্তরাষ্ট্রে বলয়ে নেই। নাঈম বলেন, তাদের হাতে এখন বিকল্প আছে। যেমন বেইজিংয়ের হস্তক্ষেপে ইরানের সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি হয়েছে।
'তোমাদের সমস্যা আমাদের সমস্যা নয়'
পশ্চিমাদের প্রতি সম্প্রসারিত ব্রিকসের বার্তা কি হবে এবং বিষয়টি বিশ্বব্যবস্থায় কতটা পরিবর্তন আনবে সে বিষয়ে এখনো মতামত জানাননি বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞ ড্যানি ব্রাডলো বলেন, সম্প্রসারণের অর্থ হলো বিশ্ব জনসংখ্যা এবং বৈশ্বিক জিডিপির বড় অংশ এখন ব্রিকস সদস্য। বিষয়টি এটাই দেখায় যে, বিশ্ব ব্যবস্থা সংস্কারে শক্তিশালী কণ্ঠ হয়ে উঠতে পারে ব্রিকস। আর সে কণ্ঠ হয়ে ওঠা নির্ভর করবে বিশ্বব্যাবস্থা সংস্কারে ব্রিকসের নতুন সদস্যরা কত বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং তারা গ্লোবাল সাউথের স্বার্থে কতটা কাজ করছে তার উপর।
নাইডু বলেন, ব্রিকসে ইরানের অন্তর্ভুক্তি জি৭, গ্লোবাল নর্থ এবং ওয়াশিংটনের কাছে বড় বার্তা পাঠিয়েছে। এটা দেখায় যে, তাদের সাথে তোমার (ইরান) সমস্যা থাকতে পারে। আমরা তোমাদের এখানে রাখব। তবে তোমার সমস্যা আমাদের সমস্যা নয়।
নাইডু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখা দক্ষিণ আফ্রিকা হয়তো কোন সমঝোতায় আসতে পারে ওয়াশিংটনের সঙ্গে। তবে একই সাথে ব্রিকসকে নিজের সুবিধার্তে ব্যবহার করারও সুযোগ আছে।
তিনি বলেন, তাদের (দক্ষিণ আফ্রিকা) হয়তো যা মন চায় তা করার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই। তবে তাদের হাতে কৌশলগত ক্ষমতা আছে। দক্ষিণ আফ্রিকা বলতে পারে, আমার সাথে এখন ব্রিকস আছে। আমার ব্রিকসের (সুরক্ষা) দেয়াল আছে।
নাঈম জিনাহ বলেন, আপতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে ব্রিকস এখনো কোন রাজনৈতিক ফোরাম হতে চায় না। তবে এ পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
তিনি বলেন, ছয় দেশকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানোর চেয়ে পশ্চিমাদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হলো ৪০টি দেশের আগ্রহ প্রকাশ। ব্রিকস সম্প্রসারণের পথে আছে…তাহলে ৩০ বছর পর জোটের অবস্থান কোথায় দাঁড়াতে পারে? যদিও ডি-ডলারাইজেশনের পরিকল্পনা এখনো নেই। তবে বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের মধ্যে দুটি নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে ডলার ছাড়া অন্য মুদ্রা ব্যবহার করলে তা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হবে।