পশ্চিমের চাপ কাজ করছে না দেখাতেই মিত্রদের জড়ো করেছেন পুতিন!
কল্পনা করুন আপনি ভ্লাদিমির পুতিন।
ইউক্রেন আক্রমণ করায় পশ্চিমারা আপনাকে প্যারিয়া বলে অভিহিত করেছে, আপনাকে একঘরে করে দিয়েছে। বিশ্ব বাজার থেকে আপনার দেশের অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আপনার বিরুদ্ধে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে।
এসব চাপ আপনার ওপর কাজ করছে না। এ অনুভূতি বুঝাতে, আপনি একটি সামিটের আয়োজন করুন।
ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসি-এর খবরে বলা হয়েছে, এ সপ্তাহে রাশিয়ার কাজান শহরে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ব্রিকস সম্মেলনে ২০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে অভ্যর্থনা জানাবেন। আমন্ত্রিত নেতাদের মধ্যে রয়েছেন চীনের শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান।
ক্রেমলিন এ সম্মেলনকে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার 'সবচেয়ে বড় পররাষ্ট্রীয় ঘটনা' বলে অভিহিত করেছে।
কনসালটেন্সি ফার্ম ম্যাক্রো-অ্যাডভাইজরির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ক্রিস ওয়েফার মনে করেন, "তাদের স্পষ্ট বার্তা হল যে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।"
তিনি বলেন, "ক্রেমলিনের বার্তাগুলোর একটি বড় অংশের অর্থ হলো, রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা সহ্য করছে। কিন্তু আমরা এও জানি, যে তলায় অনেক গুরুতর ফাটলও রয়েছে। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক স্তরে রাশিয়ার বন্ধু রয়েছে এবং তারা সবাই রাশিয়ার সঙ্গী হতে যাচ্ছে।"
রাশিয়ার বন্ধু কারা?
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে ব্রিকস গঠিত। এ সংগঠনটি মূলত পশ্চিমাদের বিরোধী দল হিসেবেই গঠন করা হয়েছে। এ সংগঠনে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে সৌদি আরবকেও এ সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বিশ্বের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ মানুষের বাস এ ব্রিকস-এর দেশগুলোতে। এ জনসংখ্যার অর্থনৈতিক মূল্য যাচাই করলে তা ২৮ দশমিক পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়, যা বিশ্বের অর্থনীতির ২৮ শতাংশ।
রাশিয়ান কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আরও ৩০টি দেশ ব্রিকসের অংশ হতে চায়। এর মধ্যে কয়েকটি দেশ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবে। আশা করা হচ্ছে, এ সপ্তাহে কাজানে আয়োজিত ব্রিকস সম্মেলন 'বিশ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ মিত্র পক্ষের' প্রতিনিধিত্ব করবে।
কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন ভূ-রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে কী অর্জন করতে চাচ্ছেন?
আশা করা হচ্ছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ কমাতে আগ্রহী রাষ্ট্রগুলো ডলারের বিকল্প মুদ্রা গ্রহণে রাজি হবেন।
ক্রিস ওয়েফার বলেন, "রাশিয়ার যে-সব অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার অনেক গুলো আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য ও অর্থপ্রদানের সঙ্গে যুক্ত। এবং এগুলোর বেশিরভাগই মার্কিন ডলারের সঙ্গে যুক্ত।"
তিনি আরও বলেন, "ইউএস ট্রেজারির বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর বিশাল ক্ষমতা এবং প্রভাব রয়েছে যার একমাত্র কারণ প্রধান মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের ব্যবহার। রাশিয়ার মূল আগ্রহ হলো মার্কিন ডলারের আধিপত্য ভাঙা। তাই ব্রিকস চায় এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিকল্প বাণিজ্য ব্যবস্থা ও আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য গড়ে উঠুক। আর এসব ব্যবস্থা ডলার, ইউরো কিংবা জি৭-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মুদ্রা দ্বারা প্রভাবিত হবে না। এর ফলে নিষেধাজ্ঞাও এতোটা প্রভাব ফেলতে পারবে না।"
কিন্তু সমালোচকরা ব্রিকসের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যের দিকে ইঙ্গিত করেন। কারণ ব্রিকসের সব সদস্য 'একই মনোভাবাপন্ন' হবেন বিষয়টি কিন্তু মোটেও সেরকম নয়।
গোল্ডম্যান শ্যাসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও'নিল এ বিষয়ে মন্তব্য করে বলেন, "কোনো কিছুতেই চীন ও ভারত একমত হতে পারে না, যা পশ্চিমাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির বিষয়। কারণ যদি তারা সত্যিই ঐক্যবদ্ধ হতো, ব্রিকস বিশাল প্রভাব রাখতে পারতো।"
তিনি আরও বলেন, "চীন ও ভারত একে অপরের উপর আক্রমণ না করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে সত্যিকারের সহযোগিতার জন্য একত্র করা একটি 'নেভার-এন্ডিং' চ্যালেঞ্জ।"
ও'নিলই শতাব্দীর শুরুতে, চারটি উদীয়মান অর্থনীতির আদ্যক্ষর নিয়ে গঠিত 'ব্রিক' নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, "বিশ্ব নীতি নির্ধারণ কেন্দ্রে আনা উচিত।"
কিন্তু এই চারটি দেশ একত্র হয়ে নিজস্ব ব্রিক গোষ্ঠী তৈরি করলে, এটি একটি নতুন জীবন লাভ করে। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেওয়ার পর এর নাম হয়, 'ব্রিকস'। তারা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সাত দেশের সংগঠন জি৭-এর প্রভাবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানানোর চেষ্টা করে।
তবে শুধু চীন ও ভারত নয়, ব্রিকসের নতুন সদস্য মিশর ও ইথিওপিয়ার মধ্যেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। আর ইরান ও সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী।
তাই ও'নিল মনে করেন, "এরা সবাই একসাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হবে, এটা একেবারেই অযৌক্তিক।"
অপরদিকে, রাশিয়া যেখানে পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাব নিয়ে 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা' তৈরির কথা বলে, সেখানে ভারতের মতো আরও অনেক দেশ পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে ভালো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।
তাই কাজানে ভ্লাদিমির পুতিনের কাজ হবে এসব ভিন্নতা দূর করা ও ঐক্যের ছবি আঁকা। এবং রাশিয়ার জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে হবে যে তার দেশ এসব নিষেধাজ্ঞা থেকে বহু দূরে।