বৈশ্বিক খাদ্য সংকট কি নতুন স্বাভাবিকতায় রূপ নিচ্ছে?
গত জুলাইয়ে ভারত যখন বাসমতি ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের সাদা চাল রপ্তানি বন্ধ করে, তখন এর ব্যাখ্যা তৈরিই ছিল দেশটির কাছে। বলা হয়, স্থানীয় পর্যায়ে জোগান বাড়িয়ে খাদ্যের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতেই এই পদক্ষেপ।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারকের থেকে আসা এই নিষেধাজ্ঞা– অবশ্যই বিশ্ববাজারে আশঙ্কার ঢেউ ছড়িয়ে দেয়। কারণ, ভারত থেকে চাল সরবরাহ পাওয়ার ওপর নির্ভর করে এশিয়া ও সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলের ডজনখানেক দেশ।
কিন্তু, ভারত বলেছে, 'ভূরাজনৈতিক কারণে বিশ্ববাজার থেকে আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়া, এল-নিনোর প্রভাবে ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোয় জলবায়ুর চরমভাবাপন্নতা' তাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। এ নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ চাল রপ্তানি।
ইউক্রেনের সাথে চলমান যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়া যখন কৃষ্ণসাগর শস্য রপ্তানি চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়, তার অনতিবিলম্বেই আসে ভারতের রপ্তানির লাগাম টেনে ধরার এই ঘোষণা। যা বড় পরিসরে খাদ্য সংকট সৃষ্টির হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞা গুরুতর কিছু প্রশ্নেরও উদ্রেক করে। আবহাওয়ার অনিয়মিত অবস্থা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং জলবায়ু-জনিত বিভিন্ন অনুঘটক বর্তমানে একসাথে কাজ করছে। এগুলোর উপস্থিতি আরো ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। ফলস্বরূপ; লাগামহীন হচ্ছে খাদ্যের মূল্য। দরিদ্র দেশগুলোয় ক্ষুধা, অনাহারের ঝুঁকি আরো তীব্রতর হচ্ছে।
এর আগে ২০২২ সালের তীব্র তাপপ্রবাহেও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতে গমের ফলন। তখনই শস্যটি রপ্তানিতে নয়াদিল্লি নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর একবছরের বেশি সময় কেটে গেলেও, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গম উৎপাদক ভারত আজও তা তুলে নেয়নি। এছাড়া, এ নিয়ে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিল দেশটি।
প্রকৃতির খামখেয়ালিতে ভুগছে আর্জেন্টিনাও। পৃথিবীর বৃহত্তম সয়া রপ্তানিকারক ও শীর্ষ ভুট্টা উৎপাদক দেশটি ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে খরার কবলে রয়েছে। এতে শস্যের ফলন ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
ভোজ্যতেলের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। এমনিতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সূর্যমুখীর তেলের সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে, এরমধ্যে গতবছর স্থানীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্বল্প-সময়ের জন্য পাম তেল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দেয় ইন্দোনেশিয়া। এতে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের চালান কেনার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
সয়াবিন তেলের অন্যতম প্রধান উৎপাদক ব্রাজিলও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খরার শিকার হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে কানাডায় ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হয় ক্যানোলা তেলের উৎপাদন।
তাহলে নিত্য খাদ্য সংকটই কি নতুন স্বাভাবিকতায় রূপ নিচ্ছে? এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিশ্ব কীইবা করতে পারে?
সংক্ষেপে তার উত্তর হলো– কৃষিতে বিরূপ আবহাওয়ার ঘন ঘন আঘাত, খাদ্য রপ্তানির বিধিনিষেধ এবং ভূরাজনৈতিক বিবাদ– পৃথিবীর খাদ্য নিরাপত্তাকে স্থায়ী হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর একটি সমাধানও আছে। চরম আবহাওয়া মোকাবিলা করে টিকে থাকার মতো শস্যের বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন ও তার আবাদ, এবং অবাধ, মুক্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করা গেলে– ভবিষ্যতের সংকটগুলো লাঘব করার সামর্থ্য পাওয়া যাবে।
ক্রমবর্ধমান রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা
বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য ভাত। প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টন ভাত খাওয়া হয় বিশ্বব্যাপী। চালের বৈশ্বিক রপ্তানির ৪০ শতাংশ করে ভারত। এছাড়া, অন্যান্য প্রধান রপ্তানিকারকদের মধ্যে আছে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র।
ভারত প্রায় সব ধরনের চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে। এরমধ্যে অসেদ্ধ আতপ চাল রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ইএন- এফএও)-র চাল বাজার বিশ্লেষক শার্লি মোস্তফা জানান, গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে এই চালের অংশ ছিল ১০ শতাংশ।
তিনি বলেন, 'আতপ চাল নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে রপ্তানি করা হয়। এরমধ্যে আছে বাংলাদেশ, নেপাল, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যামেরুন, মাদাগাস্কার ও আইভরি কোস্ট-সহ আফ্রিকার দেশগুলো এর বড় ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।'
ভারত বাসমতি ছাড়া অন্যান্য সব প্রকারের সেদ্ধ চাল রপ্তানির ওপরও ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। অথচ ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া চালের ৮০ ভাগই এ ধরনের চাল।
শার্লি মোস্তফা বলেন, রপ্তানিতে এ ধরনের বিধিনিষেধ আন্তর্জাতিক বাজারকে অস্থিতিশীল করবে। এতে বৈশ্বিকভাবে দাম বেড়ে যাবে। আগামীতে সরবরাহ আরো কমে যাওয়ার ভাবনা থেকে যেসব দরিদ্র দেশ বেশি পরিমাণে কিনে রাখার উদ্যোগ নেবে– তারাই এ মূল্যস্ফীতির প্রধান ভুক্তভোগী হবে।
বিশ্ববাজারে চালের চাহিদা সম্পর্কে বুঝতে হলে, গত বছর ভারতের নেওয়া একটি পদক্ষেপ ও তার ফলাফল জানা যাক। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, স্থানীয় বাজারে পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করতে– আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের বাসমতি নয় এমন প্রকারের সাদা চাল কেনা নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। এজন্য বাড়তি শুল্কারোপও করে রপ্তানিতে। কিন্তু, তারপরও সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত এ ধরনের চাল ২৫ শতাংশ বেশি রপ্তানি হয়।
এখন ভারত প্রায় সব ধরনের চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দেওয়ায়– বিশ্ববাজারে দর আরো চড়া হচ্ছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের পর এ বছরের জুলাইয়ে চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে জানাচ্ছে এফএও'র অল রাইস প্রাইস ইনডেক্স।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো জোসেফ গ্লবার বলেন, 'বিশ্ববাজারে চালের অন্যতম একটি মূল্যসূচক হচ্ছে থাইল্যান্ডের সাদা চালের দর, ভারতের রপ্তানি বিধিনিষেধ ঘোষণার পর থেকে যা প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে।'
কিন্তু ভারত রপ্তানি হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া একমাত্র দেশ নয়। মোট ২০টি দেশ প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বলে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ফুড সিকিউরিটি আপডেট প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
আফগানিস্তান গম রপ্তানিতে, বাংলাদেশ চালে, ক্যামেরুন ভেজিটেবল অয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়া ও উগান্ডার মতো কিছু দেশ সূর্যমুখীর তেল, গম, বার্লি, মকাই ও চাল রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ করেছে।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই খাদ্য রপ্তানিতে বিশ্বব্যাপী এ ধরনের বিধিনিষেধের ঘটনা বেড়ে চলেছে।
'বাড়ছে অনাহার'
২০২০ সালে করোনা মহামারি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। তখন থেকেই গম, ভুট্টা, চাল ও তৈলবীজের মতো প্রধান শস্যের দাম চড়তে থাকে। যা এর আগে বেশ কয়েক বছর অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল বলে জানান জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও কৃষি অর্থনীতির অধ্যাপক মতিন কাইম।
এ অবস্থায় ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে, ফলে ২০২২ সালের মার্চ নাগাদ বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য সর্বকালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় বলে এফএও'র মূল্যসারণী অনুসারে জানা গেছে।
কাইম বলেন, '২০০৭-০৮ ও ২০১১ সালের পর খাদ্যের মূল্যে এই ধরনের নাটকীয় উত্থান আমরা আর দেখিনি।'
যুদ্ধের আগে রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলিতভাবে বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ৩৪ শতাংশ করতো। যব সরবরাহে এই অবদান ছিল ২৭ শতাংশ, ভূট্টায় ১৭ শতাংশ এবং সূর্যমুখী তেলের ৫৫ শতাংশ জোগান তারা দিত বিশ্ববাজারে। কিছু অঞ্চলের খাদ্য চাহিদা পূরণে এ দুটি দেশের ওপর উচ্চ নির্ভরশীলতা ছিল। যেমন উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের ৫০ শতাংশ শস্য রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করতো।
কিন্তু, যুদ্ধকালে রাশিয়া-ইউক্রেনের বন্দরগুলো অবরোধ করলে ইউক্রেনের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। পরে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তিতে সই করে মস্কো ও কিয়েভ। এ চুক্তির আওতায়, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট ৩ কোটি ২০ লাখ টন ভুট্টা, গম ও অন্যান্য শস্য রপ্তানি করে ইউক্রেন।
তবে গত ১৭ জুলাই রাশিয়া এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেওয়ায়– এবছর ইউক্রেনের সাড়ে ৪ কোটি শস্য রপ্তানির পরিকল্পনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পরিকল্পিত রপ্তানির মাত্র অর্ধেক করতে পারবে দেশটি।
কাইম বলেন, গত দুই দশকে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে আমাদের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, তা এখন থমকে গেছে।
বর্তমানে আমরা বরং উল্টো চিত্রই দেখছি, অনাহারী মানুষের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে করে ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষুধা ও সব ধরনের অপুষ্টি মুক্ত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে।'
২০২২ সালে কোনো না কোনো পর্যায়ের অনাহারে ছিল, ৬৯ কোটি থেকে ৭৮ কোটি মানুষ– যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯.২ শতাংশ। এফএও'র ২০২৩ সালের 'স্টেট অব ফুড ইন-সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড' প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মহামারির আগের সময়ে অভুক্ত থাকতো ৭.৯ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ, লক্ষণীয় হারে বেড়েছে অনাহারীর সংখ্যা।
খাদ্য সংকটের এই বিষবাষ্পকে আরো ছড়িয়ে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এতে বিশ্বের প্রধান প্রধান খাদ্য উৎপাদনকারী অঞ্চল, যেমন কানাডা ও ইউরোপে ঘন ঘন দাবানল ঘটছে, খরার প্রকোপে ভুগছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা, চীনে আঘাত হানছে বন্যা, একইসময়ে শুস্ক হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক এলাকা।
কখনও প্রচণ্ড উষ্ণতা ও খরা, কখনোবা অতিবৃষ্টি
২০২২ সালে প্রলয়ঙ্করী এক বন্যা আঘাত হানে পাকিস্তানে। ভেসে যায় বহু ক্ষেতখামার, গবাদিপশু। বন্যায় ৮০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে গেলে– ইতোমধ্যেই ডলার সংকটে থাকা দেশটি তীব্র খাদ্য সংকটে পড়ে।
বিরূপ জলবায়ুর আরেক রূপ আবার দেখছে আর্জেন্টিনা ও স্পেন। দেশ দুটিতে তীব্র খরা এখন নিয়মিত ঘটনায় রূপ নিয়েছে। চলতি ২০২৩ সালেও দেশদুটি নজিরবিহীন খরার কবলে পড়েছে।
এল-নিনো জলবায়ু পরিস্থিতির কারণে এ বছর গমের ফলন ৩৪ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা করছে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ গম রপ্তানিকারক।
প্রচণ্ড দাবদাহে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপে ভুট্টা ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবছর। এসব তথ্য জানিয়েছে নিউইয়র্ক ভিত্তিক কৃষি-শিল্পের তথ্য বিশ্লেষক সংস্থা- গ্রো ইন্টেলিজেন্স।
বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এ বছর কেনিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, হাইতি, চিলি ও বলিভিয়াতেও শস্যের উৎপাদন কমবে।
তাত্ত্বিকভাবে, বিশ্বের এক অঞ্চলে উৎপাদন কম হওয়ার ঘাটতি, অন্য অঞ্চলে উৎপাদন বেশি হওয়ার মাধ্যমে পুষিয়ে ওঠার কথা।
নয়াদিল্লির অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ভরত রামস্বোয়ামী বলেন, 'বিরূপ আবহাওয়া ফসলের ক্ষতি করে, কিন্তু তা একইসময়ে সব দেশে ঘটে না। ফলে ওই সময়ে বিশ্বের যে অঞ্চল ক্ষতিমুক্ত থাকে, সেখানে খাদ্যের জোগান খুব একটা প্রভাবিত হয় না। বৈশ্বিক একটি খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে, যখন যেখানে সংকট আছে সেখানে সরবরাহ বাড়িয়ে তা মোকাবিলা করা যাবে। তবে এজন্য দেশগুলোর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সহযোগিতার মনোভাব থাকা দরকার- যাতে খাদ্যের চালান মুক্তভাবে বিনিময় করা যায়।'
২০২১ ও ২০২২ সালে খরা পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সহ কিছু এশীয় দেশে গম ও মকাইয়ের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, অস্ট্রেলিয়া এ দুই বছরে গমের বাম্পার ফলন হয়েছিল।
কিন্তু, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও রপ্তানি বিধিনিষেধের কারণে বর্তমানে অবাধে খাদ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে রামস্বোয়ামী বলেন, এক্ষেত্রে বিজ্ঞান আমাদের স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে। বিজ্ঞান বলছে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদে ধান, গম, ভুট্টা ও সয়াবিনের মতো প্রধান প্রধান শস্যের ফলন কমবে। তাই বিধিনিষেধ-মুক্ত খাদ্য বাণিজ্যের গুরুত্ব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
যেসব পদক্ষেপ দরকার
ফলনের পতন ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ– উভয় চ্যালেঞ্জেরই সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এক্ষেত্রে তারা একটি বৈশ্বিক কৌশল গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেন।
অধ্যাপক রামস্বোয়ামী বলেন, গত কয়েক বছরে বৈশ্বিক খাদ্যের মজুদ একই পর্যায়ে ছিল, এমনকি ২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত এফএও'র সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে– মৌলিক কিছু কৃষিপণ্যের ফলন ও মজুদ বাড়ার কথা বলা হয়েছে।
'এই অবস্থায় রপ্তানিকারক দেশগুলোর আমদানিকারক দেশগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, তারা হঠাৎ করে সরবরাহ বন্ধ করবে না, তাদের স্বার্থকে উপেক্ষা করবে না। বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক ঝুঁকি সংশ্লিষ্ট থাকায় বিশ্ববাণিজ্য এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু এ ধরনের প্রতিশ্রুতি বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর দেশগুলোর আস্থা গভীর করবে'। ফলে সংকটের কারণে দামের হঠাৎ উল্লম্ফনও ততোটা হবে না।
অধ্যাপক মতিন কাইম বলেন, একইসঙ্গে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। দেশগুলোকে আরো উন্নত ও সহনশীল জাতের বীজ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া চরম জলবায়ু পরিস্থিতির মধ্যেও টিকতে পারে এমন ধরনের ফসল উৎপাদন করতে হবে। অর্থাৎ, দেশগুলোকে কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে আরো বিনিয়োগ করতে হবে।