অনুবাদ শিল্পের মর্যাদা বাড়ানো প্রখ্যাত অনুবাদক এডিথ গ্রসম্যান মারা গেছেন
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের 'লাভ ইন দ্য টাইম অভ কলেরা', সারভান্তেসের 'দন কিহোতে'র মতো বিখ্যাত বই অনুবাদ করে সুনাম কুড়ানো অনুবাদক এডিথ গ্রসম্যান মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
এডিথের ছেলে জানিয়েছেন, তিনি প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।
সাহিত্য অনুবাদকে যখন গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হতো না, সেই লাতিন আমেরিকান ও স্প্যানিশ লেখকদের লেখা অনুবাদে মনোনিবেশ করেছিলেন এডিথ গ্রসম্যান।
বিখ্যাত বই 'হোয়াই ট্রান্সলেশন ম্যাটারস'-এ তিনি বলেছেন, অনুবাদক হচ্ছেন দুটি ভিন্ন ডিসকোর্সের, দুটি ভিন্ন অভিজ্ঞতার ও দুই ধরনের পাঠকদের মধ্যে মিলন ঘটানোর জীবন্ত সেতু।
অল্প যে কজন অনুবাদক সর্বপ্রথম অনুবাদ বইয়ের প্রচ্ছদে মূল লেখকের নামের পাশে অনুবাদকের নাম দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন, এডিথ তাদের একজন। এর আগে প্রকাশকরা আর্থিক ও প্রচারণার জন্য অনুবাদকদের নাম প্রচ্ছদে দিতেন না।
এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশকদের এই মনোভাব নিয়ে এডিথ বলেছিলেন, প্রকাশকরা বোধহয় মনে করেন তারা 'জাদুকাঠি' নাড়লেই এক ভাষার বই অন্য ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে। কাজটা করতে 'কোনো মানুষ লাগবে না। কোনো মানুষকে টাকাপয়সা দিতে হবে না।'
২০০৩ সালে প্রচ্ছদে সারভান্তেসের নামের সঙ্গে অনুবাদক হিসেবে এডিথের নামসহ 'দন কিহোতে'র অনুবাদ প্রকাশ হয়। এ ঘটনায় পেশাজীবনে এডিথ যেমন উন্নতি করেন, তেমনি সাহিত্যিক অনুবাদের মর্যাদাও বাড়ে।
হারপারকলিন্স প্রকাশিত এডিথের 'দন কিহোতে' অনুবাদটি ব্যাপক প্রশংসিত। তার সাফল্য দেখে নতুন প্রজন্মের অনুবাদকরাও উৎসাহিত হয়েছেন।
এডিথ গ্রসম্যান শুধু প্রচ্ছদে অনুবাদকের নামই চাইতেন না, অনুবাদকদের যথাযথ সম্মানী পাওয়ার দাবিতেও সোচ্চার হয়েছিলেন আরও কয়েকজনের সঙ্গে।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ইসাবেল আলেন্দে, কার্লোস ফুয়েন্তেস, লরা এসকুইভেলসহ জাদুবাস্তব ঘরানার অন্যান্য লেখকদের অনেক লেখা ইংরেজি ভাষার পাঠকদের পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন এডিথ গ্রসম্যান।
মার্কেসের অত্যন্ত প্রিয় অনুবাদক ছিলেন এডিথ গ্রসম্যান। মার্কেসের বই অনুবাদ করার অভিজ্ঞতাকে 'জটিল শব্দজাল' মেলানোর মতো বলে অভিহিত করেছিলেন তিনি।
এডিথের অনুবাদের প্রশংসা করতে গিয়ে মার্কেস বলেছিলেন, 'ইংরেজিতে আমার কণ্ঠ হলে তুমি।'
এডিথ গ্রসম্যানের জন্ম ফিলাডেলফিয়ায়, ১৯৩৬ সালের ২২ মার্চ। তার বাবা আলেকজান্ডার প্রথমে ছিল জুতার দোকানের সেলসম্যান, পরবর্তীতে নিজের জুতার দোকান দেন। তার মা সারাহ (স্টার্ন) ডর্ফ ছিলেন সেক্রেটারি ও গৃহিণী।
স্কুলের স্প্যানিশ শিক্ষক নাওমি জিয়েবারের অনুপ্রেরণায় এডিথ ইউনিভার্সিটি অভ পেনসিলভানিয়া থেকে স্প্যানিশে মেজর করেন। স্নাতকের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়ই তিনি অনুবাদ আরম্ভ করেন। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে ডক্টরেট করেন।
১৯৭০-এর দশক থেকে পূর্ণকালীন অনুবাদক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন এডিথ। পরে অনুবাদক হিসেবে খ্যাতি ছড়ানোর পর তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিসহ আর বেশ কিছু কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করার সুযোগ পান। তবে পেশাজীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি অনুবাদক হিসেবে কাটিয়েছেন।
দুই বছর সময় নিয়ে 'দন কিহোতে' অনুবাদ করেছিলেন এডিথ। কিন্তু কাজটি করে তিনি দারুণ তৃপ্তি পেয়েছিলেন। এ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, 'সারভান্তেসের সঙ্গে সতেরো শতকে ফিরে যাওয়াটা ছিল শেকস্পিয়ারের সঙ্গে ভ্রমণের মতো। নির্মল আনন্দ।'
অনুবাদের জন্য অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন এডিথ গ্রসম্যান।
যেসব লেখকদের লেখা অনুবাদ করেন, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে পছন্দ করতেন তিনি। এই লেখকদের সঙ্গে তার নিয়মিত ফোনে কথাও হতো। এডিথের লেখকরা জানতেন তিনি তাদের প্রতি কতটা নিবেদিত। লেখকরাও তার প্রতি নিবেদিত ছিলেন।
এরকম নিবেদনের একটি উদাহরণ মার্কেসের সঙ্গে একটি ঘটনা। একদিন এডিথ 'দন কিহোতে' অনুবাদে মগ্ন হয়ে আছেন, এমন সময় মার্কেস তাকে ফোন করেন। মার্কেস ঈর্ষান্বিত স্বামীর মতো এডিথকে বলেন, 'শুনলাম তুমি সারভান্তেসকে নিয়ে কাজ করছ, এতে কিন্তু আমি ঠকছি।'