ইন্ডিয়া না ভারত: দেশের নাম নিয়ে এই নতুন বিরোধ তৈরির কারণ কী?
ভারতের নয়াদিল্লিতে আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে বিদেশি অতিথিদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে দেশের নাম 'ইন্ডিয়া'র পরিবর্তে সংস্কৃত শব্দ 'ভারত' লিখেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। আর এতে করে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। অনেকেই ধারণা করছেন, হয়তো 'ইন্ডিয়া' নামটির পরিবর্তে 'ভারত' নামটিই এখন থেকে ব্যবহার করবে মোদি সরকার।
এদিকে গত মঙ্গলবার দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির একজন সিনিয়র মুখপাত্র এক্স (সাবেক টুইটার) এ জানান, চলতি মাসে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ২০তম আসিয়ান সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি 'প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত' হিসেবে অংশ নেবেন।
দেশটির সংবিধানে নাম হিসেবে 'ইন্ডিয়া' ও 'ভারত' উভয় নামেরই উল্লেখ রয়েছে। একইসাথে হিন্দুস্তান (উর্দুতে হিন্দুদের ভূমি) নামেও দেশটিকে ডাকা হয়। অর্থাৎ এই তিনটি নামের যেকোনো একটিই ভারত সরকার অফিসিয়াল কাজে ব্যবহার করতে পারে। তবে পৃথিবীজুড়ে 'ইন্ডিয়া' নামটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়।
তবে একেবারে হুট করেই যে 'ইন্ডিয়া বনাম ভারত' ইস্যু নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, বিষয়টি এমনটাও নয়। বরং জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে বিদেশি অতিথিদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে 'ভারত' ব্যবহার করার আগেই সরকারের সমালচকেরা এমনটা আন্দাজ করছিল। তাদের শঙ্কা এই যে, হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি দেশটির নাম শুধু 'ভারত' করার পরিকল্পনা করছে।
'ভারত' মূলত একটি সংস্কৃত শব্দ যেটি ধর্মগ্রন্থে প্রায় ২ হাজার বছর আগেও লিখিত পাওয়া যায়। এটি মূলত ভারতবর্ষ হিসেবে একটি অস্পষ্ট অঞ্চলকে বোঝায়, যা বর্তমানের ভারতের সীমানা ছাড়িয়েও ইন্দোনেশিয়াকে পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
বিজেপির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই যেসব শহর ও জায়গার নামের পেছনে মুঘল কিংবা উপনিবেশবাদের সম্পর্ক ছিল, সেগুলোর নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে। যেমন, গত বছর দিল্লিতে অবস্থিত প্রেসিডেন্টসিয়াল প্যালেসের মুঘল গার্ডেনের নাম পরিবর্তন করে অমৃত উদ্যান রাখা হয়েছে।
মোদির দলের নেতাদের প্রতিবাদের পর ২০১৫ সালে নয়াদিল্লির বিখ্যাত আওরঙ্গজেব রোডের নাম বদলে ড. এপিজে আব্দুল কালাম রোড রাখা হয়। নয়াদিল্লির কেন্দ্রে অবস্থিত, ঔপনিবেশিক আমলের একটি এভিনিউ যা আনুষ্ঠানিক সামরিক কুচকাওয়াজের জন্য ব্যবহৃত হতো, গতবছর সেটিরও নতুন নামকরণ করে সরকার। মোদি সরকারের ভাষ্যমতে, ভারতের হিন্দু অতীতকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসেবে নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে।
বহু সমালোচকের মতে, এমন সব উদ্যোগ মূলত ভারত থেকে মুঘলদের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টারই অংশ। অথচ মুসলিম এ শাসকগোষ্ঠী প্রায় ৩০০ বছর ভারতবর্ষে শাসন করেছে।
লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও দর্শনের অধ্যাপক রুপ রেখা ভার্মা মনে করেন, নাম নিয়ে বিতর্কের মূলে রয়েছে মোদি সরকারের অসহিষ্ণু আচরণ। তিনি বলেন, "আমরা দেখেছি সংবিধান ও আইনের প্রতি ক্রমাগত অবজ্ঞা করা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট কোনো আদেশ দিলে এবং সরকার তা পছন্দ না করলে সেটাও পরিবর্তনও করা হচ্ছে।"
রুপ রেখা ভার্মা আরও বলেন, "এরপর ঠিক কী হবে সেটা বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয়, বিরোধীরা 'ইন্ডিয়া' নামে জোট গঠন করায় তারা এখন নামটি মুছে ফেলতে শুরু করেছে।"
তবে 'ইন্ডিয়া' নামটি ঘিরে বিতর্কে বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছেন দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। দলটির অন্যতম আইনপ্রণেতা শশী থারুর মনে করেন, ভারতীয়দের উচিত "ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত, এমন একটি নাম পরিবর্তনের বদলে দুটি নামই (ইন্ডিয়া ও ভারত) ব্যবহার করা।"
"যদিও সাংবিধানিকভাবে ইন্ডিয়াকে 'ভারত' বলতে কোনো আপত্তি নেই, কারণ দেশের দুটি সরকারিভাবে প্রচলিত নামের মধ্যে 'ভারত' একটি। তবে আমি আশা করি, সরকার এতটাও বোকা নয় যে বহু শতাব্দী ধরে যেই 'ইন্ডিয়া' নামটির গুরুত্বপূর্ণ ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি হয়েছে, সেটিকে পুরোপুরি বাতিল করে দেবে।"
গত জুলাইয়ে দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালোরে কংগ্রেস-সহ দেশের ২৬টি বিরোধী দলের নেতারা মিলে 'ইন্ডিয়া' নামে একটি নতুন জোট ঘোষণা করেছেন। এই 'ইন্ডিয়া'র পূর্ণ রূপ হলো ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স।
২০২৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে এবং তার দল বিজেপিকে পরাজিত করতে এই জোট গঠন করেছেন তারা। এরপর থেকেই 'ইন্ডিয়া' বনাম 'ভারত' নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে।
অন্যদিকে বিরোধীদলীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "আমরা তো সকলেই 'ভারত' বলি। এখানে নতুন কিছু নেই। তবে বিশ্বজুড়ে আমাদের দেশের নাম 'ইন্ডিয়া হিসেবেই পরিচিত। আচমকা এমন কী হয়ে গেল যে সরকারকে দেশের নামের ক্ষেত্রে 'ভারত' ব্যবহার করতে হচ্ছে।"
তবে বিজেপির পক্ষ থেকে যুক্তি এই যে- 'ইন্ডিয়া' নামটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা প্রবর্তন করেছিলেন। দলটির সংসদ সদস্য নরেশ বানশাল মনে করেন, "ইন্ডিয়া শব্দটি একটি 'দাসত্বের প্রতীক'। তাই সংবিধান থেকে নামটি মুছে ফেলা উচিত।"
সংসদীয় অধিবেশনে বানশাল আরও বলেন, "বৃটিশরা 'ভারত' নাম পরিবর্তন করে 'ইন্ডিয়া' রেখেছিল। অথচ আমাদের দেশ হাজার বছর আগে থেকেই 'ভারত' নামে পরিচিত ছিল।"
এদিকে আগামী ১৮-২২ সেপ্টেম্বর সংসদে বিশেষ অধিবেশনে আহ্বান করেছে ভারত সরকার। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এই অধিবেশনের এজেন্ডা প্রকাশ করা হয়নি।
রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে যে, ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার হয়তো এই অধিবেশনে দেশটির নাম শুধু 'ভারত' করার প্রস্তাব দিতে পারে। তবে দেশটির তথ্যমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর থেকে শুরু করে সরকারের আরও বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অবশ্য এটিকে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ছড়ানো গুঞ্জন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
এই বিষয়ে নয়াদিল্লিভিত্তিক থিং ট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং ফেলো রাশেদ কিদওয়াই মনে করেন,' ইন্ডিয়া বনাম ভারত' ইস্যুর পেছনে মূলত রয়েছে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী উদ্বেগ। কেননা মোদী সরকারের নানা সময়ে দেওয়া বক্তৃতা প্রমাণ করে যে, তারা বিরোধীদের কাছ থেকে বেশ শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছেন৷
রাশেদ কিদওয়াই বলেন, "বিজেপি যে অনেকটা ভীত, সেটা বোঝা যাচ্ছে। দলটি মোদিকে অপরিহার্য বলে দাবি করে আসছে। তবে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী বিরোধী পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিরোধ আঁচ করতে পারছেন। আর সেজন্যই দলটির পক্ষ থেকে দেশের নাম শুধু 'ভারত' রাখার জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে।"
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ একই প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করে বলেন, "দেখুন, মোদি সরকার কতটা বিভ্রান্ত! 'প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত' যাচ্ছেন ২০তম আসিয়ান-ইন্ডিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে। বিরোধীরা একসঙ্গে এসেছে এবং তারা জোটের নাম রেখেছে ইন্ডিয়া। শুধুমাত্র সে কারণেই এখন দেশের নাম পরিবর্তন নিয়ে নাটক করা হচ্ছে।''
অন্যদিকে, বিজেপি প্রেসিডেন্ট জগত প্রকাশ নাড্ডা কংগ্রেস পার্টির কড়া সমালোচনা করে এক্স-এ লিখেছেন, "দেশের সম্মান ও গৌরবের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিষয়ে কেন কংগ্রেসের এত আপত্তি? এটা তো পরিষ্কার যে কংগ্রেস দেশকে সম্মান করে না এবং একইসঙ্গে দেশের সংবিধান বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মান করে না।"
জাতীয় কংগ্রেসের নেতা জয়রাম রমেশ এক্স-এ (প্রাক্তন নাম টুইটার) লিখেছেন, "জি-২০ সম্মেলনের নৈশভোজের আয়োজনে চিরাচরিত 'প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া'র পরিবর্তে 'প্রেসিডেন্ট অব ভারত' লেখা হয়েছে। সংবিধানের ১ নং আর্টিকেলে বলা হয়েছে: ভারত, অর্থাৎ ইন্ডিয়া একটি ইউনিয়ন অব স্টেটস। কিন্তু এবার এই 'ইউনিয়ন অব স্টেটস' হুমকির মুখে।"
এদিকে জি-২০ সম্মেলনের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রের ছবি এক্স-এ(প্রাক্তন নাম টুইটার) শেয়ার করে বিজেপি নেতা ও উত্তরাখন্ডের নির্বাচিত একজন শীর্ষ কর্মকর্তা পুস্কর সিং ধামি লিখেছেন, "দাসত্ববাদী মানসিকতার ওপর আরও একটি চপেটাঘাত।"