অবৈধ অনুপ্রবেশ: মামলা নিয়ে শঙ্কা, ভারতে এক দম্পতির একসঙ্গে থাকার লড়াই
২০১১ সালে পাকিস্তানের নাগরিক গুলজার খান অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেন। এরপর প্রেমের সম্পর্কে থাকা দৌলত বাঈ নামের এক ভারতীয় নারীকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে বিয়ে করেন। দীর্ঘ আট বছর সংসার করার পর অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের তথ্য জানতে পারে পুলিশ। গ্রেপ্তার হন গুলজার। গুলজারকে পাকিস্তানে ফেরত যেতে হবে না-কি তিনি ভারতে থাকতে পারবেন, সেটি নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। খবর বিবিসির।
ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকদের মধ্যকার প্রেমের সম্পর্কের সুখকর পরিণতি খুব কমই শোনা যায়। বরং সম্পর্কের টানে অবৈধভাবে সীমান্ত পারি দিয়ে গুলজারের মতো পরিণতির গল্পই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়।
এছাড়াও রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরি সম্পর্ক বিরাজমান। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশ দুটি পরস্পরের সাথে তিনটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আর তাই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভিসা পেতেও নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়।
সম্পর্কের টানে অবৈধভাবে প্রবেশ করে পাকিস্তান ও ভারতীয় নাগরিকদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে আসছে। গুলজার ও দৌলত বাঈয়ের গল্পটাও অনেকটা এমনই; যার শুরু হয়েছিল একটি রং নম্বরের মাধ্যমে।
গুলজারে বাড়ি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট এলাকায়। আর দৌলত বাঈয়ের বাড়ি দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে। দেশভাগের কারণে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশেই পাঞ্জাব নামের প্রদেশ রয়েছে।
গুলজার সৌদি আরবে প্রবাসী হিসেবে বসবাস করতেন। ২০০৯ সালে তিনি তার এক সাবেক সহকর্মীর সাথে যোগাযোগ করতে ভারতীয় এক ফোন নম্বরে কল দেন। কিন্তু ঐ নম্বরে সহকর্মীকে না পেয়ে তিনি নম্বর সামান্য পরিবর্তন করে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এ অবস্থায় রং নম্বর হিসেবে কল চলে যায় দৌলত বাঈয়ের কাছে।
ফোনকলটি পেয়ে দৌলত বাঈ একজন অপরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলতে অনেকটা শঙ্কা বোধ করছিলেন। কিন্তু গুলজার বেশ করে কথা বলতে চাইছিলেন। সেই থেকে শুরু হয় সম্পর্ক।
গুলজার জানান, তিনি নিজেকে পাঞ্জাবের প্রদেশের বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তিনি যে ভারত নয়, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সেটি দৌলতের কাছে স্পষ্ট করেননি। এমনকি ধর্মীয় পরিচয়ে তিনি যে একজন খ্রিস্টান; সেটাও খোলাসা করেননি। বরং নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়েই তিনি ভারতে এসে দৌলত বাঈকে বিয়ে করেন।
প্রবাসে থাকাকালীন প্রায় দুই বছর গুলজার ও দৌলত প্রতিনিয়ত কথা বলতে থাকেন। দৌলত বাঈ সন্তানসহ এক বিধবা নারী ছিলেন। তাই তিনি যখন গুলজারের সাথে ফোনে কথা বলতেন, তখন প্রতিবেশীরা তাকে বিদ্রুপ করতেন।
প্রতিবেশীদের নানা নেতিবাচক কথায় দৌলত বাঈ বেশ হতাশ হয়ে পড়তেন। এমনকি এরচেয়ে মরে যাওয়া ভালো বলেও আক্ষেপ প্রকাশ করতেন তিনি। কিন্তু গুলজার তাকে ভারতে এসে বিয়ের করার আশ্বাস দেন।
গুলজার জানান, সৌদিতে থাকাকালীন ভারতীয় ভিসার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তাই সর্বশেষে তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ছদ্মবেশ ধারণ করেন।
গুলজার ভারতীয় অ্যাম্বাসিকে বলেন, "আমি আমার পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছি। আমি একজন ভারতীয় নাগরিক! আমি দেশে ফিরে যেতে চাই।"
এক্ষেত্রে গুলজার অ্যাম্বাসিতে একটি সাদাকালো ছবির পরিচয়পত্র দেখান। যেখানে অনেকটা তার মতোই দেখতে একজন ভারতীয় নাগরিককে দেখা যায়।
এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই তাকে একটি জরুরি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। ঐ সার্টিফিকেটের ওপর ভিত্তি করে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়।
গুলজার ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের হায়দ্রাবাদে পৌঁছান। তার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা দুজন বিয়ে করেন এবং দৌলত বাঈয়ের অন্ধ্রপ্রদেশের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। গুলজার সেখানে গেলে স্থানীয় পুলিশ তাকে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ করলেও কোনো মামলা করা হয়নি।
পরবর্তী আট বছর বড় ধরনের কোন সমস্যা ছাড়াই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা সংসার করতে থাকেন। এই সময়ের মাঝে তাদের ঘরে আরও চার সন্তানের জন্ম হয়। এমনকি গুলজার আবেদন করে ভারতীয় বায়োমেট্রিক আধার কার্ড ও পরিচয় সংক্রান্ত আরও নানা ডকুমেন্ট বানিয়ে ফেলেন।
এই সময়টাতে গুলজার পাকিস্তানের নিজের পরিবারের সাথে একেবারেই সম্পর্ক ছিন্ন রাখেন। এমনকি তার চাচা তাকে খুঁজতে সৌদি আরব পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
এ সম্পর্কে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে বসবাসরত গুলজারের বোন শিলা লাল বলেন, "আমরা ভেবেছিলাম গুলজারের হয়তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে।"
এই সম্পর্কে গুলজার বলেন, "আমি যেহেতু ভারতে আমার নতুন পরিবারের সাথে ছিলাম, তাই আমি নিজেকে একজন ভারতীয় হিসেবেই গণ্য করছিলাম।"
তবে পাকিস্তানে থাকা পরিবারের কথা বেশ মনে পড়ায় গুলজার শেষমেশ পাকিস্তানে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৯ সালে ভারত থেকে পাকিস্তান যাওয়ার পথে তেলেঙ্গানা প্রদেশের একটি রেলওয়ে স্টেশনে তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানসহ গ্রেপ্তার হন। একইসাথে তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ ও জাল কাগজপত্র বানানোর অভিযোগে মামলা করা হয়।
গণমাধ্যমের রিপোর্ট মতে, পাকিস্তানে গুলজার ফোনকল করলে সেটিতে আড়ি পেতেছিল ভারতীয় গোয়েন্দারা। এ সম্পর্কে জানতে মামলাটি তদন্তের দায়িত্বে থাকা হায়দ্রাবাদ পুলিশের বিশেষ তদন্ত দলের সাথে বিবিসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
অনেকটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় এই যে, পুলিশ যখন গুলজারকে গ্রেপ্তার করে তখন তার স্ত্রী দৌলত বাঈ জানতে পারেন, তার স্বামী একজন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানী।
এ সম্পর্কে দৌলত বাঈ বলেন, "আমি পুলিশের সাথে তর্ক করছিলাম; বলছিলাম আমার স্বামীর বাড়ি পাঞ্জাবে। তখন পুলিশ আমাকে জানায়, পাঞ্জাব পাকিস্তানেও রয়েছে এবং গুলজার সেখান থেকেই এসেছেন।"
সত্যতা জেনে অনেকটা চমকে গিয়েছিলেন দৌলত বাঈ। তবে তিনি নিজের স্বামীকে একা ফেলে যাননি। বরং স্বামীর গ্রেপ্তারের পর তিনি আইনি কার্যক্রম চালিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনতে গ্রামবাসীদের থেকে অর্থ সহায়তা যোগাড় করেন।
২০২০ সালে গুলজারকে স্থানীয় একটি আদালত জামিন মঞ্জুর করে। তবে তাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে কি-না, সেই সম্পর্কে মামলার শুনানি চলছে।
২০২২ সালে তেলেঙ্গানা সরকার 'অবৈধ অভিবাসী' সংক্রান্তও একটি আদেশ জারি করে। তার ওপর ভিত্তি করে ফেব্রুয়ারি মাসে গুলজারকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে হাইকোর্টের পক্ষ থেকে বিচারাধীন মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে জামিন দেওয়া হয়।
গুলজার অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেননি। তিনি একজন পাকিস্তানী নাগরিক হয়েও যে ভারতীয় নাগরিকের ছদ্মবেশে দেশে প্রবেশ করেছেন, সেটি তিনি স্বীকার করেছেন।
এই সম্পর্কে গুলজার খান বলেন, "আমি যেমনটা করেছি সেটার সাজাই ভোগ করছি। আমার কোনো অভিযোগ নেই।"
বর্তমানে গুলজার-দৌলত দম্পতি আদালতের রায়ের অপেক্ষা করছেন। রায়ের মাধ্যমেই জানা যাবে, তারা ভারত কিংবা পাকিস্তানে একসাথে থাকতে পারবেন কি-না।
এ সম্পর্কে দৌলত বাঈ বলেন, "আমি আশা করি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে!"