উচ্চ রক্তচাপই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘাতক!
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘাতক 'হাইপারটেনশন' মোকাবিলায় প্রথমবারের মতো একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। হাইপারটেনশন উচ্চ রক্তচাপেরই এমন একটি রূপ যা বিশ্বে প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে একজনকে আক্রান্ত করে। ১৯৯০ সালের পর থেকে এই সংখ্যা দ্বিগুণ রয়েছে এবং বর্তমানে এই রোগে ভুগছেন প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মানুষ।
উচ্চ রক্তচাপের কথা শুনলে অনেকেই হয়তো এটিকে 'ধনী দেশের রোগ' বলে মনে করেন। বাস্তবে কিন্তু আদৌ তা নয়। গত মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, হাইপারটেনশনের রোগীদের তিন-চতুর্থাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বসবাস করেন। এদের মধ্যে অর্ধেক মানুষেরই ধারণা নেই যে তারা এ রোগে ভুগছেন- যা কিনা হার্ট অ্যাটাক, কিডনির অসুখ এবং স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। আক্রান্তদের চার-পঞ্চমাংশের- এমনকি যাদের রোগ নির্ণয়ও হয়েছে, আর যারা জানেনই না নিজেদের এই অসুখের কথা, তাদের কেউই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
যদি এ পরিস্থিতির উন্নতি হয় তাহলে এখন থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ৭৬ মিলিয়ন মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে। "কিছু শারীরিক সমস্যা থাকে মানুষের, যে বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের কিংবা মোকাবিলা করার মতো পদ্ধতির অভাব রয়েছে। কিন্তু হাইপারটেনশন তার মধ্যে একটি নয়। আমাদের হাতে প্রতিরোধের উপায় বা টুলস আছে।বিশ্বের সব দেশেরই সেই টুলগুলো ব্যবহার করতে জোরাল উদ্যোগ নিতে হবে", বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস। এমনকি এর আগে নিউইয়র্কে একটি ব্রিফিংয়ে টেড্রোস তার নিজের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছিলেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, উচ্চ রক্তচাপেরই আরেক নাম হাইপারটেনশন। হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত যখন শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হয়, তখন ধমনির দেয়ালে চাপ প্রয়োগ করে এবং এই চাপ বেশি থাকলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়।
দু'টি মানের মাধ্যমে এই রক্তচাপ রেকর্ড করা হয়। হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও সম্প্রসারণের সময় একবার সিস্টোলিক প্রেশার হয়, যাকে প্রেশারের উপরের দিকের পরিমাপক বলা হয়; আর একবার ডায়াস্টলিক প্রেশার হয়, যাকে সহজ ভাষায় নিচের দিকের রক্তচাপ পরিমাপক বলা হয়।
একজন সুস্থ মানুষের রক্তচাপ থাকার কথা ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। কিন্তু সেটি যদি কারো ১৪০/৯০ এর বেশি থাকে তখন সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বলে চিহ্নিত করা হয়। এ পর্যায়ে রক্তের প্রবল চাপে ধমনীর ক্ষতি হতে পারে এবং হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন পৌঁছানোর পরিমাণ কমে যায়।
রক্তচাপ বিভিন্ন কারণে বাড়তে পারে এবং বিশ্বে বিভিন্ন স্থানভেদে তা ভিন্ন হতে পারে; যেমন- প্রচুর লবণ খাওয়া, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পান, তামাক সেবন, দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া এবং ব্যায়াম না করা। এ সমস্যার প্রতিকারও সহজ, যদিও ক্ষতির পরিমাপ করা সহজ নয়। সঠিক ডায়েট, সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ, উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্য ব্যবস্থা তৈরি- যাতে করে সহজে রোগ নির্ণয় এবং পর্যবেক্ষণে রাখা সম্ভব হয়।
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর প্রাক্তন পরিচালক এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রিসলভ টু সেভ লাইভস-এর সিইও ও সভাপতি টম ফ্রিডেন পৃথক একটি ব্রিফিংয়ে বলেন, "এখানে মূলকথা হলো, বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর একটি পরিস্থিতিকেও অবজ্ঞার চোখে দেখা হচ্ছে। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে উচ্চ রক্তচাপেরর সমস্যায় রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও নির্দেশিকা রয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য আরও অনেক আগে থেকেই সেই সুযোগ থাকা উচিত ছিল।"
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিকল্পনাতে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকে সরকারি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার করা বলা হয়েছে; অর্থাৎ একটি দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করবে এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় এটির ওপর জোর দেওয়া হবে। (এর সঙ্গে থাকা প্রতিবেদনে কানাডা এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ দুটি দেশে যারা হাইপারটেনশনে ভুগছেন, তাদের অর্ধেকের বেশি মানুষের এই রোগ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছে)।
এছাড়াও, কম খরচের মধ্যে এই সমস্যাটি নিয়ে কাজ করতে আরও বেশি লোক নিয়োগ দেওয়ার জন্য সমাজকল্যাণ কর্মী বা স্বেচ্ছাসেবক এবং প্যারাপ্রফেশনালদের সংগঠিত করার কথাও বলা হয়েছে ডব্লিউএইচও'র পরিকল্পনায়। সবশেষে বলা হয়েছে, যে মানদণ্ড বজায় রেখে সরকার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনবে- যে ওষুধগুলো অতটা নামীদামি ব্র্যান্ডের নয় এবং দামে সস্তা। একইসঙ্গে রোগীদের শারীরিক অবস্থা নজরে রাখা এবং চিকিৎসার জন্য ডেটা সিস্টেম তৈরি করার কথাও বলা হয়েছে।
"আমি উগান্ডা থেকে এসেছি এবং আমি আশির দশকে বেড়ে উঠেছি। আমাদের সময়ে হাইপারটেনশনকে ধনীদের রোগ বলে মনে করা হতো। কিন্তু এখন আর এমনটা ভাবা হয় না", বলেন জাম্বিয়ার ভ্যানডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার-এর অধ্যাপক অ্যানেট কিরাবো। তিনি জাম্বিয়াতে হাইপারটেনশন নিয়ে একটি গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছেন।
"আফ্রিকা পশ্চিমাকরণ হচ্ছে। এখানে প্রচলিত কিছু ডায়েট যা উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য কার্ডিওভাসকুলার রোগের জন্য দায়ী, যেগুলো সাব-সাহারান আফ্রিকাতেও দেখা যায়", বলেন তিনি।
উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ হলো অধিক লবণ খাওয়া এবং কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক হতে পারে; কারণ জেনেটিক মিউটেশনের কারণে তাদের দেহ লবণের প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে, তবে এখানে অন্যান্য ফ্যাক্টরও এটিকে প্রভাবিত করতে পারে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে এরকম কিছু সমস্যা দেখা যায়; যেমন- নতুন শহরে স্থানান্তরের ফলে মানুষের প্রচলিত ডায়েটে পরিবর্তন আসা, ব্যায়াম করায় অক্ষমতা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সূক্ষ কণার সংস্পর্শে আসা।
"উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটা খুবই জটিল বিষয়। শহুরে অঞ্চলে স্থানান্তর, খাদ্য ও সংস্কৃতির পরিবর্তন, সেবাযত্ন পাওয়া, উচ্চমাত্রার দূষণ- এই সবকিছুর সমন্বয়ের ফলেই উচ্চ রক্তচাপ অনেক বেড়ে যায়", বলেন কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন-এর কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও কার্ডিওলজিস্ট সঞ্জয় রাজাগোপালন।
ডব্লিউএইচও'র পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, শুধুমাত্র সহানুভূতির খাতিরে নয়, বরং খরচ বাচানর জন্যেও হাইপারটেনশনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সব দেশের অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ থেকে মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মৃত্যুই ঘটে ৭০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে- যার মানে পরিবার ও দেশের জিডিপিতে তাদের অবদান হারিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটির উদ্ধৃত আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে মাত্র ১ ডলার ব্যয় করলে ভবিষ্যতে তা ১৮ ডলার খরচ কমাতে পারে।
যেহেতু সদ্যই করোনাভাইরাস মহামারির ধকল কাটিয়েছে বিশ্ব, তাই এই মূহুর্তে বিশ্ববাসীকে আরও একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলার দিকে মনোযোগ দিতে বলাটা হয়তো বেশিই হয়ে যাবে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, এ সমস্যা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
যদিও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বের প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কিন্তু সংক্রামক অর্গানিজম দ্বারা সৃষ্ট নয় সেসব রোগে আক্তান্ত হয়েও প্রতি বছর ৪১ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। আর কোভিডের তুলনায় হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ কোন রহস্যজনক অসুস্থতা নয়। এ রোগের উপসর্গ থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই মানুষ বুঝতে পারে এবং এর চিকিৎসায় সুলভ মূল্যের ওষুধও রয়েছে।
কিন্তু নতুন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, মানুষ হাইপারটেনশন নামক অসুস্থতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। "সাধারণত, অসংক্রামক রোগগুলোকে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই তেমন গুরুত্ব দেন না। এগুলোকে উদীয়মান সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, যখন কিনা দশকের পর দশক ধরেই সমস্যাগুলো মহামারি আকার ধারণ করেছে", বলেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল-এর 'প্রোগ্রাম অব ননকমিউনিকেবল অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ'-এর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কার্ডিওলজিস্ট জিন বুখম্যান।