রুপার্ট মারডকের সন্তান কারা? তার উত্তরসূরি বা পরিবার সম্পর্কে কতটুকু জানা যায়!
গত সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ফক্স কর্পোরেশন ও নিউজ কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মিডিয়া মোগলখ্যাত রুপার্ট মারডক। তার জায়গায় দায়িত্ব নেবেন তার বড় ছেলে লকল্যান মারডক।
কয়েক দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গোটা একটা গণমাধ্যম সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন রুপার্ট মারডক- যার যাত্রা শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে তার বাবার সংবাদপত্রের মাধ্যমে। বর্তমানে এই অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান বিজনেস ম্যাগনেট বিশ্বের শীর্ষসারির একজন বিলিয়নিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রে মারডকের প্রতিষ্ঠান ফক্স নিউজ আমেরিকান রাজনীতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে এবং মারডককে কারো কাছে হিরো, আবার কারো কারো কাছে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যবসায়িক কৌশল ও আন্তঃপারিবারিক দ্বন্দ্বের নানা গল্পের সাথে সাথে মারডকের পরিবারও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। বলা হয়েছিল, রুপার্ট মারডক এবং তার পরিবার, বিশেষ করে তার সন্তান জেমস, লকল্যান, এলিজাবেথ এবং প্রুডেন্স এইচবিওর টিভি শো 'সাকসেশন'-এর মডেল হবেন।
মারডকের বিয়ে নিয়েও গণমাধ্যমে কম আলোচনা হয়নি। মারডক চারটি বিয়ে করেছেন এবং ঐ স্ত্রীদের সংসারে তার ছয় সন্তান রয়েছে।
লকল্যান মারডক রুপার্ট মারডকের দ্বিতীয় স্ত্রী আনার ছেলে। বাবা চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যাওয়ার পর নিউজ গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত লকল্যান। একইসঙ্গে তিনি ফক্স কর্পোরেশনের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করবেন। রক্ষণশীল নিউজ নেটওয়ার্ক ফক্স নিউজ, ফক্স ব্রডকাস্ট ও স্পোর্টস নেটওয়ার্ক এবং স্থানীয় টিভি স্টেশনগুলো ফক্স কর্পোরেশনের মালিকানাধীন।
ডিজনি 'টুয়েনন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স' অধিগ্রহণের পর ২০১৯ সাল থেকেই ফক্স কর্পোরেশনের সিইওর পদে রয়েছে লকল্যান। একত্রীকরণের আগে লকল্যান ২০১৫ সাল থেকে টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; অন্যদিকে, তার ভাই জেমস ফক্সের তৎকালীন বিনোদন ব্যবসায়ে সিইও ছিলেন- এটিকে বিশ্লেষকরা 'কম্পিটিটিভ পাওয়ার-শেয়ার' বলে বর্ণনা করেছিলেন, যা ছিল তাদের বাবারই পরিকল্পনা।
১৯৯০' এবং ২০০০'র দশকে নিউজ কর্পোরেশন নামে পরিচিত পারিবারিক ব্যবসার নির্বাহী পদে ধাপে ধাপে উন্নীত হন লকল্যান। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি ডেপুটি চীফ অপারেটিং অফিসার পদে ছিলেন; এছাড়াও তিনি ফক্স টেলিভিশন স্টেশনসের চেয়ারম্যান এবং নিউইয়র্ক পোস্টের প্রকাশক পদেও রয়েছেন।
সংবাদমাধ্যম সিএনএন সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে এই এই নেটওয়ার্ক পরিচালনা নিয়ে কোম্পানির সাবেক শীর্ষ নির্বাহী রজার এইলসের সাথে বিবাদের পর সাময়িকভাবে কোম্পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন লকল্যান। এক দশক পরে আবার তিনি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্সের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসেন। মাঝের ওই বিরতির সময় তিনি 'ইলিরিয়া পিটিওয়াই' নামে একটি বেসরকারি বিনিয়োগ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
লকল্যানের ছোট ভাইয়ের জেমস মারডকও রুপার্টের দ্বিতীয় স্ত্রী আনার সন্তান।
টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স-এ সিইও হিসেবে কাজ করার বাইরে, বিগত বছরগুলোতে জেমস বিভিন্ন সময়ে নিউজ কর্পোরেশনে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও নিউইয়র্ক পোস্টসহ তাদের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত কন্টেন্ট নিতে মতবিরোধের জেরে তিনি পরিবার-নিয়ন্ত্রিত প্রকাশক বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন।
মারডক ভাইদের মধ্যে জেমস অপেক্ষাকৃত মুক্তমনা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০২০ সালে পদত্যাগের পর তিনি বলেছিলেন, "কোম্পানির সংবাদ আউটলেটগুলোতে প্রকাশিত কিছু সম্পাদকীয় কন্টেন্ট এবং আরও কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়ে মতানৈক্যের কারণে" তিনি সরে দাড়াচ্ছেন। জেমস এর আগে নিউজ কর্পের এডিটোরিয়াল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন, তিনি ফক্স নিউজ কভারেজের সঙ্গে একমত নন।
পারিবারিক ব্যবসায় আসার আগে জেমস 'রকাস রেকর্ডস' নামে একটি রেকর্ড লেবেল প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৫ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপআউট হন। পরে এই রেকর্ড লেবেলটি নিউজ কর্পোরেশন কিনে নেয় বলে একাধিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়।
পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি স্টার ইন্ডিয়ার সিইও, স্কাই-এর সিইও (তৎকালীন ব্রিটিশ স্কাই ব্রডকাস্টিং) এবং স্কাই-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেমস ২০১১ সালে 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারি'তে জড়িয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু দুজনেই এর দায় অস্বীকার করেছেন।
ভাইদের মতো এলিজাবেথও কয়েক দশক আগে পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হন এবং দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু ভাইদের মতো বড় নেতৃত্ব তাকে দেওয়া হয়নি, ফলে পরবর্তীতে তিনি নিজেই একটি মিডিয়া ভেঞ্চার শুরু করেন।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এলিজাবেথ ব্রিটিশ স্কাই ব্রডকাস্টিং-এর হয়ে স্কাই নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু ২০০০'র দশকে প্রধান নির্বাহীর পদের জন্য তাকে বিবেচনা না করায় তিনি কোম্পানি ছেড়ে চলে যান বলে তৎকালীন গণমাধ্যমে বলা হয়।
এক বছর পরে তিনি নিজের স্বাধীন প্রযোজনা সংস্থা 'শাইন' নিয়ে যাত্রা শুরু করেন এবং ২০০০ সালে নিউজ কর্পোরেশন এই প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণ করে। এর মাধ্যমে পারিবারিক ব্যবসায় আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয় তার। কিন্তু পরবর্তীতে এক যৌথ উদ্যোগের ভিত্তিতে 'শাইন'কে এন্ডেমোলের সঙ্গে একত্রীকরণের পর পারিবারিক ব্যবসায়ে এলিজাবেথের প্রাধান্য কমে যায় এবং তিনি ডে-টু-ডে অপারেশন থেকে সরে দাঁড়ান।
২০১৯ সালে এলিজাবেথ একটি গ্লোবাল কন্টেন্ট কোম্পানি 'সিস্টার' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং এরপর থেকে তিনি বিনোদন ও ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিতে একজন উদ্যোক্তা ও মানবহিতৈষী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন।
প্রুডেন্স মারডক ম্যাকলিওড রুপার্ট মারডকের প্রথম স্ত্রী প্যাট্রিসিয়ার মেয়ে এবং তার সবচেয়ে বড় সন্তান।
যদিও অন্যান্য সৎ-ভাইবোনদের মতো প্রুডেন্স পারিবারিক ব্যবসায় শীর্ষে ওঠার জন্য সমান আগ্রহ দেখাননি; তবে লকল্যান, জেমস এবং এলিজাবেথের মতো পারিবারিক ট্রাস্টে তারও সমান অংশ রয়েছে।
প্রুডেন্স অবশ্য নিজেকে নিউজ কর্পোরেশন থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে সরিয়ে রাখেননি এবং বছরের পর বছর ধরে কোম্পানিতেও বেশকিছু ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। তিনি ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত টাইমস নিউজপেপার লিমিটেডের বোর্ডে দায়িত্বে ছিলেন। টাইমস নিউজপেপারস লিমিটেড নিউজ ইউকে'র অধীনে একটি প্রতিষ্ঠান, যেটির মালিকানা রয়েছে নিউজ কর্পোরেশনের হাতে।
রুপার্ট মারডকের সর্বকনিষ্ঠ দুই সন্তান হলেন গ্রেস এবং ক্লোয়ি মারডক। তৃতীয় স্ত্রী ওয়েন্ডি ডেং এর সংসারে তার এই দুই সন্তানের জন্ম হয়।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং তাদের লিংকডইন অ্যাকাউন্ট থেকে জানা যায়, গ্রেস ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ক্লোয়ি পড়ছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলাদা একটি ট্রাস্টের অধীনে অসংখ্য নন-ভোটিং শেয়ারের সুবিধাভোগী তারা দুজন।