মঙ্গোলিয়ার আলতাই পর্বতমালার সোনালি ইগল–শিকারিদের সন্ধানে
পশ্চিম মঙ্গোলিয়ার আলতাই পর্বতমালা। ছোট্ট বসতঘরের পাশে কাঠের লাঠির ওপর চুপচাপ বসে আছে একটি সোনালি ইগল।
পাখিটার পায়ের সঙ্গে দড়ি বাঁধা। মাথা আর চোখ কালো লেদারের টুপি দিয়ে ঢাকা; কেবল ঠোঁটটা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। বুনো পরিবেশ থেকে ছোটবেলায় ধরে আনা ইগলটিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিকারি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
বেলা গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা। ২৩ বছর বয়সী সমসের বাহিতনূর গরু দুইতে লেগে পড়লেন। সমসেরের পরিবারের ইগল–শিকারের (ইগল পাখি ব্যবহার করে শিকার) খ্যাতি রয়েছে। তার বাপ ও দাদা কয়েক দশক ধরে একাধিক জাতীয় টুর্নামেন্টও জিতেছেন। ঘরের ভেতর সেসব অর্জনের ছবি শোভা পাচ্ছে।
২০১৩ সালে ইসরায়েলি আলোকচিত্রী আশের ভিদেনস্কির একটি ছবি ভাইরাল হয়। ওই ছবির বিষয়বস্তু ছিলেন তরুণ ইগল–শিকারি আইশলপান নুরগাইভ। সে ছবির দরুন মঙ্গোলিয়ার কাজাখ নারীরা বৈশ্বিক মনোযোগ পান।
২০১৪ সালে ভিদেনস্কি ব্রিটিশ পরিচালক অটো বেলকে নিয়ে আবারও কাজাখস্তান যান। বেল কিশোরী নুরগাইভকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। সেখানে ইগল–শিকারি কিশোরীকে কাজাখ সংস্কৃতিতে প্রথাবিরোধী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন হয়।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সিবিএস-এর একটি শোতে পরিচালক অটো বেল নুরগাইভকে কাজাখদের '২,০০০ বছর ধরে চলে আসা পুরুষপ্রধান ইতিহাসে প্রথম নারী ইগল–শিকারি' হিসেবে অভিহিত করেন। তবে কাজাখস্তান আর ইতিহাসবিদেরা বলছেন, এ কথা একেবারেই সত্য নয়।
কাজাখস্তানের ৬৭ বছর বয়সী বাগদাত মুকতেপকেকিজি একজন সাবেক ইগল–শিকারি ও অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক। ১৯৬৬ সালে ১০ বছর বয়সে প্রথম ইগল–শিকারের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি।
'আমার বড়দাদার ইগল, বাজ, চিল মিলিয়ে প্রায় ২০০টা শিকারি পাখি ছিল। আমি আমার দাদা আর বাবার কাছে ইগল–শিকার শিখেছি। ইগল কীভাবে ধরতে হয়, ইগল দিয়ে শিকার — সবকিছুই আমি জানি,' বলেন তিনি।
'ইগলের টমাগা (টুপি) খুলে নিয়ে সেটাকে শিকারে পাঠানোর মধ্যে গর্ব আর আনন্দের এমন একটা অনুভূতি আছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না,' বাগদাত জানান।
বাগদাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়েছেন। তবে তার কর্মজীবনের সঙ্গেও জুড়ে গিয়েছিল ইগল। পড়ালেখার পর সাংবাদিকতা শুরু করেন তিনি। সে সুবাদে গ্রামে-গ্রামে ঘুরে ইগল, গ্রেহাউন্ড, ঘোড়া ইত্যাদি নিয়ে খবর প্রকাশ করতেন তিনি।
ইগল–শিকারের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে কাজাখস্তানে ১৯৯৮ সালে ইগল প্রশিক্ষণের প্রথম স্কুল চালু করেছেন বাগদাত। এছাড়া এ শিল্পকে জাতীয় খেলায় রূপ দেওয়ার জন্য কাজাখ সরকারকেও রাজি করিয়েছেন এ নারী।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অ্যাড্রিয়েন মেয়র কাজাখ ইগল–শিকার নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, এ ধরনের শিকারে সবসময় নারীরা জড়িত ছিলেন। 'এমনকি প্রত্নতত্ত্ব বলছে, প্রাচীন সময়ে নারী ইগল-শিকারির সংখ্যাই বেশি ছিল।
মেয়র ব্যাখ্যা করেন, কাজাখরা সিদিয়ান যাযাবর জাতির বংশধর। সিদিয়ানরা দক্ষ ঘোড়সওয়ার ও তীরন্দাজ ছিলেন। 'তারা স্ত্রী ও পুরুষকে সমান বিবেচনা করতেন। ছোট ছোট গোত্রে নারী-পুরুষ, তরুণ-বৃদ্ধ সবাইকে যুদ্ধ করা, ঘোড়ায় চড়া ও ইগল দিয়ে শিকার করতে হতো।'
তবে বর্তমানে আর সব জায়গার মতো কাজাখদের মধ্যেও নারী-পুরুষ শ্রমবিভাজন তৈরি হয়েছে। এর একটা কারণ হতে পারে কাজখরা এখন আর আগের মতো যাযাবর নেই, যাপিত জীবনে তারা অনেকটাই থিতু জনগোষ্ঠী। আর আধুনিক সময়ে ইগল দিয়ে শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করার দরকারও হয়না এখন।
আলতাই পর্বতমালাজুড়ে গাছের সংখ্যা বেশ কমই। তাই সোনালি ইগল এ পর্বতের ফাটলে বাসা বাঁধে। শীতে এখানকার তাপামাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত নামতে পারে। পুরো পর্বতমালা তখন বরফে ঢেকে যায়। কোথাও কোথাও সে জমাটবাঁধা বরফ কোমর পর্যন্ত হয়। সুপেয় পানির হ্রদগুলোও জমে যায়।
শীতকাল কাজাখদের শিকার করার চূড়ান্ত মৌসুম। কারণ চারপাশে বরফসাদার মধ্যে খুব সহজেই শিকার দেখতে পারে তীক্ষ্ণদৃষ্টির অধিকারী ইগলগুলো।
ইগল আর তার মানুষ শিকারির মধ্যে সম্পর্কটাও খুবই গাঢ় হয়। সব শিকারির নিজস্ব পাখি থাকে। ইগল ছানার ওড়ার মতো বয়স হলেই শিকারি ছানা ধরে এনে শিকারের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। স্ত্রী ইগল বড় আর আগ্রাসি বলে সাধারণত এগুলো দিয়েই শিকার করা হয়। শিকারদক্ষতা আর পাখির বিশ্বাস; দুটো অর্জনেই কয়েক বছর লাগে।
ইগল নিয়ে শিকারের কাজটাও সহজ নয়। শিকারিকে এক হাত দিয়ে ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অন্য হাতে থাকে প্রায় সাত কেজি ওজনের পাখিটি। এ অবস্থাতেই হাড়জমানো বরফের ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়।
শিকারির সঙ্গে একটি ইগল সাত থেকে ১০ বছর থাকার পর সাধারণত ইগলটিকে পুনরায় জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয় যাতে পাখিটির প্রজনন স্থবির হয়ে না যায়।
মঙ্গোলিয়ায় ইগল–শিকার এখন পুরোদস্তুর শিল্প হিসেবেই টিকে আছে বলে জানান উমেন অভ কাজাখস্তান হিস্টোরি নামক একটি এনজিও'র প্রতিষ্ঠাতা দিনারা আসানোভা। কাজাখ নারীদের ইগল–শিকারের ঐতিহ্য কয়েক শতকের এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ব্যাপকভাবে বদলে গিয়েছে, বলেন তিনি।
পিএইচডি গবেষক আসানোভা বলেন, কাজাখস্তানে এ বদল ঘটেছে সোভিয়েতরা সেখানে আসার পর। 'তারা আমাদের যাযাবর জীবনকে বদলে দিয়ে সমাজকে শহুরে করে দিয়েছে,' বলেন তিনি।
সোভিয়েতরা কাজাখস্তানে কল-কারখানা তৈরি করে কাজাখদের স্থায়ীভাবে বসবাসে বাধ্য করে। তার দরুনই ইগল–শিকারের ঐতিহ্য প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এছাড়া কখন কাজাখদের নিজস্ব অনেক শিল্পও নিষিদ্ধ করেছিল সোভিয়েতরা।
কাজাখস্তান থেকে মঙ্গোলিয়ায় যেসব কাজাখ চলে এসেছিলেন, তারা নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তাই মঙ্গোলিয়ায় অনেক কাজাখ এখনো সোনালি ইগল পোষেন।
মঙ্গোলিয়ার ওলগি শহরের বাইরে সোনালি ইগল উৎসব অনুষ্ঠান হয়। তিন দিনের এ উৎসবে ইগল–শিকারের প্রতিযোগিতায় যেকোনো বয়স বা লিঙ্গের কেউ অংশ নিতে পারে। এ প্রতিযোগিতায় জিতলে পাওয়া যায় অর্থ, মেডেল আর খ্যাতি।
বর্তমানে অনেক কাজাখ নারীই এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু ঐতিহ্য অনুযায়ী, জাতশিকারি হতে হলে তাদেরকে উৎসবের মঞ্চের বাইরে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে হয়, তীব্র শীতের সময় বুনো পরিবেশ থেকে ইগল দিয়ে শিকার ধরে আনতে হয়।
কাজাখস্তানে ৩৫ বছর ধরে ইগল উৎসবের আয়োজন করছেন বাগদাত। তিনি বলেন, জাতীয় ইগল খেলায় আজকাল আর কোনো মেয়ে অংশ নেন না।
বাগদাতের প্রাক্তন এক ছাত্রী মাকপাল আবদ্রাজাকোভা ২০১২ সালে ২৪ বছর বয়সে ইগল–শিকারি হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছিলেন। 'সে পাঁচ–ছয় বছর ধরে শিকার করেছিল। কিন্তু এখা আর করে না। বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চাও আছে দুটো,' বলেন বাগদাত।
বাগদাতের ভাইয়ের আট বছর বয়সী মেয়ে ইগল আর বাজপাখি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবে কোনো নারী আর আজকাল শিকারের সঙ্গে যুক্ত নেই বলে জানান বাগদাত। 'এখন আর কেউ শিকার করে না। এটা একটা শখ হিসেবে টিকে আছে, উৎসবগুলোই টিকিয়ে রেখেছে। তরুণেরা মাঝেমধ্যে আনন্দের জন্য একটু চেষ্টা করে, কিন্তু তারা দ্রুতই হাল ছেড়ে দেয়।'
সংক্ষিপ্ত অনুবাদ