শখের তোলা আশি টাকা: জমিদারদের শিকার-জীবন
লেখাটি মূলত 'শিকার স্মৃতি' নামক একটি বইয়ের কিঞ্চিৎ পাঠপ্রতিক্রিয়া। যেকোনো বই পড়ার পরের অনুভূতি লেখায় প্রকাশের নামই পাঠপ্রতিক্রিয়া নয়, এর আরও কতগুলো শর্ত প্রতিপালনের বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে আমি একেবারেই শর্তমুক্ত, ফলে আমার এই অনুভূতির প্রকাশকে অন্য কোন শব্দমালায় উল্লেখ করতে পারলেই ভালো হতো, কিন্তু সঠিক শব্দ ব্যবহারের অক্ষমতায় 'পাঠপ্রতিক্রিয়া' হিসেবেই অভিহিত করতে হলো।
'শিকার স্মৃতি' বইটির লেখক শ্রীজিতেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরী (১৮৮৪-১৯৪১)। আমি যে বইটি পড়েছি এটি সম্পাদনা করেছেন খান মাহবুব। খান মাহবুব সম্পাদনার পাশাপাশি বইটির নবায়ন করেছেন, ভূমিকা লিখেছেন এবং প্রয়োজনীয় টীকা দিয়েছেন। 'শতবর্ষের নতুন সংস্করণ' হিসেবে 'ঐতিহ্য' থেকে বইটি নতুনভাবে প্রকাশ হয়েছে।
শিকার ও শিকার-সম্পর্কিত বই প্রসঙ্গে কিছু বলা আবশ্যক। ইতোপূর্বে শিকার-সম্পর্কিত কোনো বই পড়া হয়নি। বলা ভালো, ইচ্ছে করেই পড়িনি। কিন্তু এটি কেন পড়লাম? বইটির লেখক শ্রীজিতেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরী, মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ির সন্তান ও বংশানুক্রমিক জমিদার। আমার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। আমাদের গ্রামাঞ্চল ও আশেপাশের অঞ্চলে মুক্তাগাছার জমিদারদের তালুকদারি ছিল বলে জানি। সম্পাদক যথার্থই লিখেছেন, 'শিকারের বর্ণনা যদি শতবর্ষ প্রাচীন ও পূর্ববঙ্গের হয় তবে পাঠকদের আগ্রহ ঢের বেশি বৈকি'। পূর্ববঙ্গ ছাপিয়ে যখন পার্শ্ববর্তী গ্রামে এসে শিকারের বয়ান হাজির হয় তখন সম্পাদকের অনুমানের চেয়েও ঢের বেশি আগ্রহ অনুভূত হয়েছে বলে স্বীকার করছি। যতদূর জানি, মুক্তাগাছার জমিদারদের নানারকম সুনামের পাশাপাশি বদনামও কম ছিল না। এসব আমার আলোচ্য বিষয় নয়। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আঞ্চলিকতা প্রীতিতেই এই বইটি পড়ার আগ্রহ জন্মায়। সম্পাদক যেমনটা লিখেছেন, 'এই শিকার শুধু রোমাঞ্চ নয়, তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতির এক যুতসই দর্পণ'। এবং পড়তে পড়তে যখন আমার গ্রামের পাশের গ্রামের উল্লেখ পেলাম, তখন প্রায় ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করার দশা হয়েছিল। অবশেষে এভাবেই বইটি পড়া হয়ে গেলো।
এবার সম্পাদনা প্রসঙ্গে কিছু বলা প্রাসঙ্গিক। অতীতকালের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বই নতুনভাবে ছাপার ক্ষেত্রে সাধারণত সম্পাদনার প্রয়োজন হয়। এরকম সম্পাদিত বইয়ের সম্পাদকীয় ভাষ্যেই বইটির গুরুত্ব, প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিশদভাবে উল্লেখিত হয়। এবং সামগ্রিকভাবে বইটিকে পাঠকের কাছে সহজভাবে উপস্থাপিত করে। 'শিকার স্মৃতি'র ক্ষেত্রেও এসব গুরুত্বসহকারে উপস্থিত আছে। কিন্তু কিছু সমস্যাও রয়েছে। শতবর্ষ পূর্বে রচিত এই বইটির ভাষা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কাছে অপ্রচলিত, যদিও সেকালে এমনতর ভাষাই ব্যবহার্য ছিল। আর শিকারের সাথে বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বৃক্ষ, লতা-পাতা, উপরন্তু শিকারসংশ্লিষ্ট পরিভাষার ব্যবহার বর্তমানকালের সাধারণ পাঠকদের কাছে একটু খটোমটো লাগা স্বাভাবিক। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে টীকা যুক্ত করে 'শিকার স্মৃতি' বইটি পাঠকের হাতে তুলে দেবার জন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাই।
এবার বই প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। আমাদের ছোটবেলায়, বিগত আশির দশকে শুনেছি অমুক গ্রামের তমুক জঙ্গলে একদা বাঘ ছিল, হরিণ তো এই আমাদের পাড়ার বাঁশঝাড়েই ছিল। এসব চাক্ষুষ করেছেন, এমন কাউকে সাক্ষী হিসেবে পাইনি। কিন্তু কারও নানা, কারও দাদা, এমনকি বয়স্ক কারও পিতৃদেব এসব প্রত্যক্ষ করেছেন এবং পরম্পরা হিসেবে তাদের গল্প বলার দায় মিটিয়েছেন আমাদের শুনিয়ে। আমাদের কচি বয়স, ঠিক ঠিক বিশ্বাস করে শিহরিত হয়েছি। বয়স একটু পাকা হতে শুরু করতেই, এসব গল্পকে গালগপ্প বলে উড়িয়ে দিয়েছি, অনেকটা বয়সেরই দোষে। সুন্দরবন আর চিড়িয়াখানা ছাড়া বাঘ-হরিণ কোথাও থাকতে পারে? এরকম মিশ্র অনুভূতি নিয়েই মধ্যচল্লিশে পৌঁছে গেছি। এমন সময়েই শ্রীজিতেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর 'শিকার স্মৃতি' পড়ার সুযোগ করে দিলেন সম্পাদক খান মাহবুব। পড়তে পড়তে ছোটবেলার সেসব শ্রুত গল্পগুলোর কথা মনে পড়ছিল। মুরুব্বিদের গল্প শুধুই গল্প নয়, গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর। আমাদের ইউনিয়নের নিকটবর্তী ভবানীপুর ইউনিয়নেই ১৯০০ সালের দিকে মুক্তাগাছার জমিদার বাঘ শিকার করেছেন, হরিণ শিকার তো পানিভাত! ভবানীপুর বর্তমানে ফুলবাড়িয়া উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম। আছিম, বওলা বিল, বটগাছিয়া কান্দা, পোড়াপুঠিয়া, সোনবিলা, সাঘরদিঘী এসব তো দেখে-শুনে এসেছি। 'শিকার স্মৃতি' বইটিতেও এসব পাওয়া গেল। এসব এলাকাজুড়ে জমিদার ও জমিদারনন্দনেরা শখের শিকার করে মনোরঞ্জন করেছেন।
শিকারের সীমানা শুধু নিজ তালুকেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আশেপাশের জমিদারদের নিমন্ত্রণে শিকারে গেছেন হরহামেশা। ব্রিটিশ ভারতের সমগ্র, এমনকি সুদূর নেপালেও শুধু শিকারের উদ্দেশ্যে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন, যা স্মৃতি হিসেবে লিখেছেনও।
'শিকার স্মৃতি' শুধু শিকারের বর্ণনায় সিক্ত নয়, এতে পাওয়া যায় সেকালের প্রাণ ও প্রকৃতির নানান সরস বয়ান। প্রায় শতবর্ষ পূর্বে আমাদের সমাজব্যবস্থা কেমন ছিল, তারও অল্পবিস্তর তথ্য উপজাত (বাইপ্রোডাক্ট) হিসেবে পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় বাংলা ভাষার শতবর্ষ পূর্ব-রূপ। অনেক শব্দ, যেমন বাইদ, কান্দা, চালা, নালা, লোটা, বাথান, বয়ার ইত্যাদি আমার শিশুকালে গ্রামে প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে অপ্রচলিত। এসব শব্দের ব্যাখ্যা কখনও খোঁজাও হয়নি, অনেকটা গ্রাম্য শব্দ বলে এড়িয়ে গেছি। সৈয়দ শামসুল হকের 'কথা সামান্যই' বইতে অনেক শব্দের নানারকম ব্যবহার ও ব্যাখ্যা পড়ার কথা মনে পড়ছে। কিন্তু এসবের ব্যবহার এবং ব্যাখ্যা শ্রীজিতেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরী চমৎকারভাবে দিয়েছেন। যেমন, 'বনভূমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডগুলির নাম চালা। দুই চালার মধ্যে তৃণপূর্ণ যে প্রান্তর লক্ষিত হয়, তাহাকে বাইদ বলে'। কান্দার ক্ষেত বা ঐ কান্দা—এভাবে আমাদের কাছে প্রচলিত কান্দাগুলো মূলত নদী বা বিলের কিনারের উঁচুভূমি হিসেবে ফুটনোটে উল্লেখ করা হয়েছে। জেলখানার সম্বল লোটা-বাটি-কম্বল কিংবা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের 'লোটাকম্বল'-এর বদৌলতে লোটা চেনা গেলেও বাথান ও বয়ার? আমরা ছোটবেলায় অনেকগুলো গরু বা ছাগলের একত্রে অবস্থানকে বলতাম গরু বা ছাগলের বাতান, এই বাতানই মূলত বাথান। বয়ার একটি মজার শব্দ বা নাম। একটু নাদুস-নুদুস, কালো ষণ্ডা গোছের কাউকে মুরুব্বিরা মজা করে বয়ার বলতেন। এতদিনে জানলাম, বয়ার হলো একধরনের বন্য পুরুষ মহিষ। মুরুব্বিদের রসবোধের প্রশংসা না করে উপায় নেই। এসব লিখতে লিখতে মনে হলো, আমারই এরকম ভ্রম হলো নাকি আরও কারও হতে পারে? যাহোক, হাতির লাদ-এর ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, 'হাতির একদিনের উপযোগী খাদ্যদ্রব্য যাহা তাহার পিঠে চাপাইয়া দিয়া আনীত হয়, তাহাকেই হাতির লাদ বলে'। মজার ব্যাপার, সেকালে সরকারের পক্ষ থেকে হাতির উচ্চতা অনুযায়ী খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হতো বলেও জানিয়েছেন শ্রীজিতেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরী।
শুধু এরকম অপ্রচলিত শব্দ নয়, হারিয়ে যাওয়া অনেক স্থান, বহু রাজা-জমিদারের কথাও উল্লেখ করেছেন, যারা সমভিব্যাহারে শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন, শিকার করেছেন। এ এক জীবনের গল্প বটে! যেখানে দুঃখ, জরা, গ্লানির স্থান নেই, কেবল আনন্দ আর আনন্দ!
আজকাল আমরা রাস্তাঘাটের বেহাল দশা দেখে আফসোস করি, অমুক দেশের রাস্তাগুলো কত ভালো কিংবা অন্যান্য বিষয়ে বলে থাকি 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম'। নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জের কথা লিখেছেন, 'ময়মনসিংহ হইতে এই স্থানের দূরত্ব ১৪ মাইল। ইহার মধ্যে আমরা ছয়-সাত মাইল মাঠের ভিতর দিয়া গাড়ি চালাইয়া আসিয়াছি। বঙ্গদেশের অধিকাংশ জেলা-বোর্ডের রাস্তার অবস্থাই সাধারণত শোচনীয়। রাস্তার জীর্ণ-সংস্কারের জন্য বোর্ড অর্থব্যয়ে উদাসীন নহেন, মেরামতের কাজও বিলক্ষণ উৎসাহের সহিত সম্পন্ন হয়; কিন্তু পরিদর্শকের সংখ্যাধিক্যবশতই হউক, আর অন্য যে কারণেই হউক, বৈদ্যসংকটে রোগী মারা যাওয়ার মতো, পথের দুর্গতি দূর হয় না'। এই বয়ানের মাধ্যমে শতবর্ষ পূর্বের বঙ্গদেশের মানুষের কর্ম-কীর্তি বুঝতে নিশ্চয়ই কারও অসুবিধা হবে না।
শ্রীজিতেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর পিতার নাম শ্রীযুক্ত রাজা জগৎকিশোর আচার্য্য চৌধুরী (১৮৬৪ - ১৯৩৮)। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট জমিদার এবং শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বহু অর্থ দান করে 'দানবীর' হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ময়মনসিংহের 'বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠাকল্পে ৫০,০০০ টাকা দান করেছিলেন। সংগীত ও সাহিত্যে অনুরাগী সমঝদার এবং দক্ষ শিকারি হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মুক্তাগাছার জমিদারদের ১৬টি অংশ ১৬ জন জমিদার পরিচালনা করতেন। তারা প্রথমে রাজা এবং পরে মহারাজা উপাধি পেয়েছিলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে। এদেরই একজন মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী। যিনি তার ভাতিজা ও দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর নামে শশীলজ বানিয়েছিলেন। এজন্যই সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী ও শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর নাম অত্যধিক পরিচিত বলে অনুমান করি। জমিদার কীর্তন করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
বলাবাহুল্য, শিকার মূলত নেশা। শখের নেশা। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যেমন নেশা। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পূর্ব পর্যন্ত সম্ভবত সব জমিদারেরাই এই নেশায় ঘোরগ্রস্ত ছিলেন। ব্রিটিশ আমলা-বণিকদের অনেককেই শিকারের প্রতি নিবেদিত থাকার কথাও জানা যায়। শ্রীজিতেন্দ্র কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর শিকার স্মৃতি পাঠে জানলাম, সেকালেও লোকে শখ করে চুলে কলপ দিতেন। কথায় আছে, শখের তোলা আশি টাকা। শিকার যে শখের বিষয়, এটি নিয়ে সন্দেহ নেই।
যেকোনো পাঠক শখ করে শিকার স্মৃতি বইটিও পড়তে পারেন। জঙ্গলের নড়াচড়া দেখেই শিকারিরা বুঝতে পারেন কোন জানোয়ার জঙ্গল নাড়াচ্ছে। সেই মোতাবেক অস্ত্রে শান দেয় শিকারিরা। এই লেখাতেও পাঠকের জন্য ব্যঞ্জনাপূর্ণ কোন নড়াচড়া আছে এবং পাঠক বইটিতে ফুসকি মারবে কিনা এবং সেসব কেবল পাঠকের উপরেই নির্ভরশীল।