ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত: জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার জবাবে গাজা উপত্যকায় পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে করে ঐ অঞ্চলে উত্তেজনা ও হতাহতের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলছে। এমতবস্থায় মধ্যেপ্রাচ্যে সৃষ্ট এ সংকট নিয়ে আজ (রবিবার) জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।
গতকাল (শনিবার) এক বিবৃতির মাধ্যমে জরুরি বৈঠকের বিষয়টি জানানো হয়। আজ স্থানীয় সময় বেলা ৩ টায় শুরু হওয়া বৈঠকে ফিলিস্তিন সংকটসহ মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
বর্তমানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব পালন করছে ব্রাজিল। গতকাল (শনিবার) দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে, "আমাদের সরকার গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলে চালানো সিরিজ বোমা হামলার নিন্দা জানায়। এমতবস্থায় ব্রাজিলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পরিষদের একটি জরুরি সভা আহ্বান করা হবে। একইসাথে পরিস্থিতির যাতে আরও খারাপের দিকে না যায় তাই সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সহনশীল আচরণের আহ্বান জানানো হবে।"
গতকাল (শনিবার) সকালে গত কয়েক বছরের মধ্যে ইসরায়েলে সবচেয়ে বড় আক্রমণ চালায় হামাস। এ আক্রমণে মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থান ও অবকাঠামো লক্ষ্য করে ৫ হাজার রকেট ছোড়ে বলে জানিয়েছে হামাস।
হামাসের আক্রমণে অন্তত ৩০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে টাইমস অভ ইসরায়েল। আহত হয়েছে দেড় হাজারের বেশি ইসরায়েলি।
এই হামলা সম্পর্কে হামাসের উপ-প্রধান সালেহ আল-আরোরি বলেছেন, তাদের এ লড়াইয়ের উদ্দেশ্য স্বাধীনতা অর্জন। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে তিনি বলেন, "এটা কোনো (চোরাগোপ্তা) অপারেশন নয়। আমরা সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছি। আমার লড়াই চালিয়ে যেতে এবং লড়াইয়ের পরিধি বাড়াতে চাই। আমাদের প্রধান লক্ষ্য একটা: আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের পবিত্র স্থানগুলোর স্বাধীনতা।" তিনি বলেন, বিজয়, মুক্তি ও স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত হামাস লড়াই চালিয়ে যাবে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় ২৩৪ জন নিহত এবং ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। এছাড়া কয়েক ডজন আহত ফিলিস্তিনির অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে আল জাজিরা। বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে বলেও জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
হামাসের আকস্মিক হামলার পর জনগণের উদ্দেশে দেওয়া বিবৃতিতে হামাসকে 'নজিরবিহীন মূল্য'ও চুকাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, "ইসরায়েলের জনগণ, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি (উই আর অ্যাট ওয়ার)। ...আজ সকালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ও এর জনগণের বিরুদ্ধে খুনে হামলা চালিয়েছে হামাস।'
হামাসের হামলার কয়েক ঘণ্টা পর নেতানিয়াহুর এই ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। তিনি বলেন, "পাশাপাশি আমি সর্বোচ্চ সংখ্যায় রিজার্ভ সেনাদের সমবেত করার নির্দেশ দিয়েছি। যাতে এমন বড় ও তীব্র পাল্টা হামলা চালানো যায়, শত্রুপক্ষ আগে কখনোই যেমন হামলার সম্মুখীন হয়নি।"
এদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্সির দায়িত্বে থাকা ব্রাজিলের কূটনীতিবিদ সার্জিও ফ্রাঙ্কা ডেনিজের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে নিরাপত্তা পরিষদকে অবিলম্বে হামাসের হামলার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশের আহ্বান জানানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, "নিরাপত্তা পরিষদসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হামাস এবং সমস্ত সন্ত্রাসী সংগঠনের দ্বারা পরিচালিত ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন নিন্দা জানানো। ইসরায়েল এই বর্বর সন্ত্রাসবাদ এবং নিরীহ পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যার প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলের সংহতি ও সমর্থন প্রত্যাশা করে।"
একইসাথে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ হামাসকে সহযোগিতার জন্য ইরানের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা ও চিলির পক্ষ থেকেও হামাসের এই হামলার প্রতিবাদে নিন্দা প্রকাশ করা হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-ও ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
চরম পরিণতি এড়াতে আমিরাত সংঘাতে লিপ্ত উভয়পক্ষের প্রতি সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন এবং অবিলম্বে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকরের আহ্বান জানায়। একইসঙ্গে, 'এই অঞ্চলে আরও সংঘাত, উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতা রুখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরব-ইসরায়েলি শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু' করার তাগিদ দিয়েছে আমিরাত।
উপসাগরীয় দেশ ওমান উভয়পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের জীবনরক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। ওমানের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম বলেছে, "ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অব্যাহত দখলদারি, ধারাবাহিক ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলস্বরূপ সংগঠিত এই সংঘাতের দিকে উদ্বেগ সহকারে দৃষ্টি রাখছে ওমান। এর পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।"
এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান 'পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে এমন আগ্রাসী কার্যকলাপ থেকে সংযত ও বিরত থাকতে' ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এরদোগান বলেন, "আমরা সকল পক্ষের প্রতি যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করছি, এবং উত্তেজনাকে আরও উস্কে দেওয়ার মতো হঠকারী পদক্ষেপ না নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।"
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, "ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা অব্যাহত রেখে সংঘাতকে বর্তমান রূপ দেওয়ার জন্য একমাত্র ইসরায়েল-ই দায়ী।"
কাতার উভয় পক্ষের প্রতি সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের পাশাপাশি – এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে ইসরায়েল যেন গাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরেকটি অসম যুদ্ধ শুরু করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়।
ইসরায়েলের ওপর আক্রমণের ঘটনায় রাশিয়াও 'সংযম' প্রদর্শনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। রাশিয়ার বেসরকারি বার্তাসংস্থা ইন্টারফ্যাক্সকে দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিখাইল বোগদানভ বলেন, "ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি ও আরব দেশগুলোসহ আমরা সকল পক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছি। আমরা অবশ্যই সংযমের আহ্বান জানাই।"
এদিকে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র বলেছেন, "ইসরায়েলি নাগরিকদের ওপর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হামাসের এই হামলার 'সুস্পষ্ট নিন্দা' জানায় যুক্তরাষ্ট্র। আমরা দৃঢ়ভাবে ইসরায়েলের সরকার ও তাদের জনগণের সঙ্গে আছি।
মুখপাত্রের বরাত দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন- এর প্রতিবেদনে বলা হয়, "যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান তার ইসরায়েলি সমকক্ষ তেজাচি হানেগবির সাথে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিষয়ে তারা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অব্যাহত রাখবেন।"
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইইউ কমিশন প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, 'ইসরায়েলের ওপর হামাসের এই সন্ত্রাসী হামলাকে' তারা তীব্র নিন্দা জানান।
ইইউ পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, 'ভয়াবহ এই সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতা কোন সমাধান হতে পারে না। সংকটময় এই সময়ে ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানাচ্ছে ইইউ।'
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, "ইসরায়েল ও তার জনসংখ্যার বিরুদ্ধে চলমান সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানাচ্ছে ফ্রান্স।" একইসাথে প্যারিস ইসরায়েলের প্রতি তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেন, "শনিবার ইসলামী গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে যে অতর্কিত আক্রমণ করেছে আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।"