হামাসের আক্রমণ কেন ১৯৭৩ সনের অক্টোবরে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ মনে করিয়ে দেয়
গতকাল শনিবার (৭ অক্টোবর) গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের আক্রমণের পর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। ৫০ বছর আগে, ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশ- মিশর ও সিরিয়া যৌথভাবে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। সেবারও এই হামলার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না ইসরায়েলিরা। যুদ্ধের পর গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে তদন্তও করেছিল তেল আবিব। এ যুদ্ধের পরিণতি, কেবল ওই অঞ্চলেই নয়, বরং পুরো বিশ্বেই পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এ সংঘাত 'ইয়ুম-কিপুর যুদ্ধ' নামে পরিচিত, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে এ যুদ্ধ রমজান মাসের যুদ্ধ নামেও পরিচিত।
ওই যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে বিজয়ী তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মিশর ও সিরিয়া দুই দিক থেকে ইসরায়েল আক্রমণ করলে যুদ্ধের সূচনা হয়। অধিকৃত সিনাই উপদ্বীপ দখলমুক্ত করতে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করে মিশর। অন্যদিকে, অধিকৃত গোলান মালভূমি ফিরে পেতে উত্তর দিক থেকে অভিযান পরিচালনা করে সিরিয়া।
এ যুদ্ধের প্রায় ছয় বছর আগে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধে বিজয়ী ইসরায়েল এ ভূখণ্ড দুটি দখলে নেয়। একইসঙ্গে, ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের যেটুকু তখনো তাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছিল, সে অংশও সরাসরি দখল করে বসে।
নব-গঠিত ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটি ১৯৬৭ সনের যুদ্ধে জয়ের পর তখন বিজয়ানন্দে অন্ধ। আরব সেনাদের পেশাদারিত্ব সম্পর্কেও ঘোর সন্দিহান। ইসরায়েলের শীর্ষ কর্মকর্তারা ধরেই নিয়েছিলেন, আরবরা আধুনিক যুদ্ধ লড়তে জানে না। এদিকে পরাজয়ের গ্লানিতে আরব বিশ্বে ক্ষোভ তখন চরমে। বিশেষ করে, মিশরের জনগণ চাইছিল প্রতিশোধ, আর হৃত ভূমি সিনাই উপত্যকার উদ্ধার। মিশরের সেনাবাহিনীও তখন নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ খুঁজছে। সিরিয়ার নেতা হাফিজ আল-আসাদও চাইছিলেন গোলান মালভূমি ফিরে পেতে। ফলে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে গোপন এক সামরিক চুক্তি করেন তিনি। যুদ্ধের মিশরীয় অংশের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন চিফ অব স্টাফ সাদ এল সাজলি। আর সিরিয়ায় স্বয়ং হাফিজ আল আসাদ।
দীর্ঘ প্রস্তুতির পর দুই দেশ মিলে– ইহুদি ধর্মালম্বীদের পবিত্র দিবস ইয়োম কিপুরের দিন ইসরায়েলে হামলা করে। এ যুদ্ধকে প্রভাবিত করেছিল তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধের বিশ্ব রাজনীতি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আরব দেশদুটিকে অস্ত্র সরবরাহ করে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলকে সমর্থন করছিল। ১৯৬২ সনের কিউবার মিসাইল সংকটের পর ইয়ুম কিপুর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো সামরিক সংঘাতের মুখোমুখিও হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র- সোভিয়েত ইউনিয়ন।
যুদ্ধের প্রথমদিকে, সিনাই উপত্যকা দখল করে নেয় মিশর। অন্যদিকে, কৌশলগত ভুলের কারণে সুযোগ থাকতেই গোলান মালভূমি উদ্ধারে ব্যর্থ হয় সিরিয়া। তবে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থায়, বিপাকে পড়ে ইসরায়েল। কিন্তু, পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহের সুবাদে যুদ্ধ শুরুর ১০ দিন পর, ১৬ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনী মিশর ও সিরিয় বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করতে সমর্থ হয়। ফলে যুদ্ধের মোড় তারা নিজেদের অনুকূলে আনতে পারে তারা। যদিও লড়াইয়ে দেখা দেয় অচলাবস্থা।
দখলদার ইসরায়েলকে যুদ্ধে সমর্থন দেওয়ায়, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক- এর মাধ্যমে আরব দেশগুলো তেল উৎপাদন পাঁচ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জ্বালানি তেল বিক্রিতেও অবরোধ আরোপ করে, এবং ওয়াশিংটনের কাছে তেলের চালান বন্ধ রাখে। এতে বিশ্ববাজারে হু হু করে বেড়ে যায় তেলের দাম, যা এমনকী স্নায়ুযুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে প্রভাব ফেলে।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধ অবসানের উপায় খুঁজতে উদ্যোগী হয়। তৎকালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার উদ্যগ নেন। এসময় তিনি কায়রো, দামাস্কাস ও তেল আবিবে টানা যে সফর করেন, তাই পরবর্তীকালে 'শাটল ডিপ্লোম্যাসি' নামে পরিচিত পায়।
কিসিঞ্জারের এ চেষ্টা সফল হয়, এবং একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকরের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান হয়।
কয়েক বছর পর, ১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি সই করে ইসরায়েল ও মিশর। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার রূপরেখা নির্ধারিত হয়।
ইয়ুম কিপুর যুদ্ধের ফলেই উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এই উদ্যোগ আসে। তারপর থেকে আর কখনোই ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি আরব দেশগুলো।