ইসরায়েলের সাথে লড়তে গোপনে যেভাবে ‘মিনি আর্মি’ গড়েছে হামাস
হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল। এত বড় সেনাবাহিনী নিয়ে এখনো জোর আক্রমণ শুরু না করার কারণ হলো তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রশিক্ষিত এবং অনেকটাই উন্নত সমরাস্ত্রে সজ্জিত একটি গোষ্ঠীর মুখোমুখি হচ্ছে।
৭ অক্টোবরের সুকৌশলী ও অত্যন্ত পরিকল্পিত হামলাকে হামাসের সামরিক পারদর্শিতার প্রদর্শন বলে মনে করা হচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ হামাস কর্মকর্তা আলি বারাকা বলেন, প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জন্ম দেয়। তিনি জানান, দীর্ঘ সময় ধরে ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহর অর্থ ও সামরিক সহায়তার পাশাপাশি হামাস নিজেদের অস্ত্র তৈরিতেও মনোযোগ দিয়েছে।
লেবাননে থেকে নিজের দায়িত্ব পালন করা বারাকা বলেন, অস্ত্র আমদানিতে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হওয়ায় আমরা নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়েছি এবং সদস্যদের প্রশিক্ষিত করেছি।
২০০৮ সালে গাজা যুদ্ধে হামাসের ব্যবহৃত রকেটগুলোর সর্বোচ্চ পরিসীমা ছিল ৪০ কিলোমিটার। আর ২০২১ সালের সংঘাতে তা বেড়ে হয়েছিল ২৩০ কিলোমিটার।
হামাসের সক্ষমতার ধারণা পেতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও সামরিক বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছে রয়টার্স। তাদের অনেকে মনে করেন, অনেকটাই গোপনে কার্যক্রম চালানো বিস্তৃত সংগঠনটির অনেক কিছুই এখনো ফিলিস্তিনিদের কাছেও অজানা।
গাজায় হামাস সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র জানায়, হামাস 'ছোট আর্মির' মতো। তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্রসহ হামাসের পৃথক মিলিটারি একাডেমি আছে। সামরিক শাখার ৪০ হাজার সদস্যের মধ্যে হামাস পৃথক নৌ বিভাগও দাঁড় করিয়েছে।
অথচ গ্লোবাল সিকিউরিটি ওয়েবসাইটের মতে, ১৯৯০ এর দশকে হামাসের হাতে কেবল ১০,০০০ যোদ্ধা ছিল।
এক আঞ্চলিক নিরাপত্তা কর্মকর্তার মতে, বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি করতে, নিজেদের অস্ত্র তৈরির কারখানা সুরক্ষিত করতে এবং প্রয়োজনে যোদ্ধাদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে একটি বিস্তৃত টানেল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে হামাস।
হামাস কর্মকর্তা জানান, তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ বোমা, মর্টার শেল, ক্ষেপণাস্ত্র, অ্যান্টি-ট্যাংক, আকাশ প্রতিরক্ষা মিসাইল মজুত আছে।
এই সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলও পেয়েছে হামাস। ২০০৮ সালের সংঘাতে কেবল ৬ জন এবং ২০১৪ সালে ৬৬ জন যোদ্ধা হারায় হামাস, যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
ব্রিটেন রয়েল ইউনাইটে সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো এইচ. এ হেলয়ার বলেন, আসন্ন হামলায় হামাসকে ধ্বংস করতে সক্ষম ইসরায়েল। কিন্তু প্রশ্ন সক্ষমতা নিয়ে নয়; বরং গাজায় বেসামরিকদের ওপর হামলার প্রভাবই মুখ্য। কারণ হামাস উপদ্বীপের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় বা মরুভূমির কোনো গুহায় থাকে না। তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত।
২০২১ সালের সংঘাতে হামাস এবং তার সাথে সম্পৃক্ত ইসলামিক জিহাদ তাদের ৪০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র সুরিক্ষত রাখতে সক্ষম হয়, যা ইসরায়েলি বাহিনীর মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্সটিটিউটের তথ্যমতে, সংঘাতের পূর্বে তাদের ২৩,০০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। পরে তা কমে দাঁড়ায় ১১,৭৫০।
জোরদার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
ইসরায়েল বিরোধী প্রতিবাদ থেকে জন্ম হওয়া হামাসকে জঙ্গি সংগঠনের তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা ও মিশর।
অন্যদিকে ইরানের কাছে হামাস হলো হিজবুল্লাহর মতোই ইসরাইলকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখার অন্যতম অস্ত্র। হামাস নেতারা কাতার ও লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের মূল ভিত হলো গাজা। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি ইসরায়েলের হামলার মুখে ফিলিস্তিনিদের তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ না করার আহ্বান জানিয়েছে।
৭ অক্টোবরের হামলা ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে। প্রায় ৩,০০০ এর বেশি রকেট একের পর এক ছুড়তে থাকে হামাস। প্যারাগ্লাইডিং করে তাদের সদস্যরা ঢুকে পড়ে দক্ষিণ ইসরায়েল সীমান্তে। ইসরায়েলের অত্যাধুনিক লৌহ প্রাচীরের ২৯টি পয়েন্ট দিয়ে তারা মোটরসাইকেল নিয়ে ঢোকে। এমনকি বুলডোজার দিয়েও সীমানা গুড়িয়ে দে।
রয়টার্সকে সূত্র জানিয়েছে, ইরান কর্তৃক প্রশিক্ষিত হলেও ৭ অক্টোবরের হামলায় তেহরানের সরাসরি সম্পৃক্ততা বা তাদের দিকনির্দেশনার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা সবই হয়েছে হামাসের হাতে। তবে অবশ্যই প্রশিক্ষণ, প্রস্তৃতি ও সমন্বয় হয়েছে ইরানে।
হামাসকে অর্থ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয় স্বীকার করলেও হামলায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে ইরান।
গত বছর আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়েহ বলেন, তারা ইরান থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সামরিক সহায়তা পেয়েছে। তিনি বলেন, স্থানীয় কারখানায় উৎপন্ন রকেট আছে আমাদের হাতে, তবে বেশি দূরত্বে আঘাতে সক্ষম রকেটগুলো বিদেশ থেকে আনা। ইরান, সিরিয়া ও মিশর দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীদের ইরান প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হামাসের সামরিক শাখার জন্য তহবিল বাড়িয়ে দেয় ইরান।
হামাস কর্মকর্তা বারাকা বলেন, ৭ অক্টোবরের হামলার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ৫,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তি, আল-আকসায় ইসরায়েলের তল্লাশি বন্ধ করা এবং গাজায় ১৬ বছরের অবরোধ তুলে নেওয়া।
তিনি সতর্ক করে বলেন, যুুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মদদে যদি ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরু হয়, তাহলে এই যুদ্ধ আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেবে।
তিনি বলেন, এটা কেবল গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ হবে না, এটা হবে গাজায় আটলান্টিকের যুদ্ধ, যেখানে নতুন 'খেলোয়াড়রাও' ফ্রন্টলাইনে থাকবে।