ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় এক যাত্রা; ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের দক্ষিণ গাজায় পালিয়ে আসার অভিজ্ঞতা
আসিল মুসা, কাজ করেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে। থাকতেন পশ্চিম গাজা উপত্যকার তাল আল-হাওয়াতে। শুক্রবার সকালে ইসরায়েল কর্তৃক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণ গাজায় যাওয়ার নির্দেশ পাওয়া ১১ লাখ ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিও একজন। আসিল মুসা নিজেই লিখেছেন তার নিজ ভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার করুণ গল্প।
আসিল মুসার বক্তব্য:
শুক্রবার সকালে আমাদের কাছে কোনো ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। গাজায় খাদ্য ও পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। একই সময়ে মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ চলতে থাকে। শুক্রবার ৬টার দিকে, আমার চাচাতো ভাই টেলিফোনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে।
চাচাত ভাই বলে, 'আসিল, আমরা খবরে দেখেছি এবং জানি যে আপনার কাছে সম্ভবত ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আভিচায় আদ্রাই উত্তর এবং পশ্চিম গাজার বাসিন্দাদের দক্ষিণ অঞ্চলে সরে যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছে।'
আমাদের অবস্থা এমনিতেই ভয়াবহ ছিল। আমরা অবিশ্বাস্য রকম চাপে এবং উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমার কাছে শুধু পাসপোর্ট, আমার আইডি এবং কয়েক জোড়া জামাকাপড়সহ একটি ব্যাগ প্রস্তুত ছিল।
আমি ঠিক করতে পারছিলাম না আমার সাথে কি নিয়ে যাব। তাল আল-হাওয়া আমার বাড়ি। আমি ২৫ বছর ধরে সেখানে বসবাস করেছি। আমি কেবল নিজের পরিচয় শনাক্তকরণ নথি নিয়ে বের হয়েছিলাম।
আমি এবং আমার পরিবার আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। দক্ষিণ গাজার আল মাগোজিতে থাকা আমার আত্মীয়র কাছে আশ্রয় চাই।
আল মাগাজি পর্যন্ত আমাদের যাত্রা ছিল ভয়ঙ্কর। দলে দলে মানুষ পালাচ্ছিল। দক্ষিণে পালানোর জন্য এত মানুষকে কেবল ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছে। মানুষ যে উপায়ে পেরেছে দক্ষিণে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
এই যাত্রা আমাকে ফিলিস্তিনি টিভি সিরিজ 'দ্য প্যালেস্টাইন ডায়াসপোর ' এর কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে ১৯৪৮ সালের নাকবার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। শিশু, যুবক, নারী সবাই ট্রাকে করে পালাচ্ছিল। আমরা মোট সাতজন আমার বাবার গাড়িতে করে রওনা দেই।
১৯৪৮ সালের নাকবাতে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য আল মাগাজিতে শরণার্থী শিবির বানানো হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দ্রুত বুঝতে পারলার যে আমরা এখানেও নিরাপদ নই। কথায় বলে, আমরা মৃত্যু থেকে মৃত্যুর দিকে ছুটছি।
সেখানেও বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট সংযোগ নেই এমনকি বিশুদ্ধ পানিও নেই। খাদ্য সরবরাহও সীমিত। আমার মামার দোতলা ভবনেই উত্তর থেকে পালিয়ে আসা ৩০ থেকে ৪০ জন লোক ছিল।
গাজায় নিরাপদ বলতে কোনো জায়গা নেই। বোমা থেকে রক্ষার শেল্টার নেই। ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ অব্যাহত আছে। রকেটের শব্দ ভয়ঙ্কর। এক সপ্তাহে ইসরায়েলি বোমা হামলায় প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
আমি পশ্চিম গাজা অঞ্চলে বসবাসকারী অনেক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা সবাই দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছি। এক বন্ধু মিশরীয় সীমান্তের রাফাহ শহরে, আরেকজন খান ইউনিসে। আমরা বিক্ষিপ্ত, অনিশ্চিত যে আমরা আবার মিলিত হব কিনা। পরিস্থিতি গভীরভাবে যন্ত্রণাদায়ক।
সাধারন নাগরিক, যাদের রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই
আমি এখানে ক্যাম্পে লোকজনের সাথে দেখা করেছি। তাদেরই একজন কিশোরী মরিয়ম। নিজের বাড়ি ধ্বংস হওয়ার খবর পেয়েছে জার্মান প্রবাসী ভাইয়ের মাধ্যমে। তিনি অনলাইনে বাড়ি ধ্বংসের ছবি দেখে মরিয়মদের জানান। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় মরিয়মরা সে ছবি দেখতে পায়নি।
২০০৮ সালে গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধে একবার তাদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর তারা সেটি আবার তৈরি করে। এখন আবার সেটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মরিয়মের মা বিধ্বস্ত, কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তার বাবা ভেঙে পড়েন কান্নায়।
তারা সাধারণ বেসামরিক, কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়। তারপরও তাদেরকেই ভুগতে হচ্ছে।
মরিয়মের বাবা হাসান ইসরায়েলে চাকরি করেন। তার কাছে একটি পারমিট আছে কিন্তু গত সপ্তাহে হামাসের নেতৃত্বাধীন হামলায় বেইট হ্যানউন (ইরেজ) ক্রসিং ধ্বংস হওয়ার পর, তিনি আশঙ্কা করছেন যে, আর কাজ করতে পারবেন না। এতে পরিবারের আয়ের প্রাথমিক উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। মরিয়ম আমাকে বলেছে, বাবার আয় না থাকলে তাদের হয়তো অনাহারে থাকতে হতে পারে।
সম্প্রতি বাগদান হয়েছে মরিয়মের। বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি সাজাতে অনেক কিছু কেনা হয়েছিল। সবকিছুই বাড়ির সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে গেছে।
আমি আমার চারপাশের মানুষের এমন অসংখ্য গল্প শেয়ার করতে পারি। কিন্তু আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন আমি কেমন অনুভব করছি, আমি সম্ভবত ভেঙে পড়ব।
আমি একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করি। বিবিসি রেডিও, একটি কানাডিয়ান টিভি স্টেশন এবং একটি আমেরিকান টিভি স্টেশন আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে।
কিন্তু সীমিত ইন্টারনেট সংযোগ এবং বিদ্যুতের অভাবের কারণে যোগাযোগটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। আমি ভিডিও বা ভয়েস রেকর্ড করি। যেগুলো প্রযোজকদের কাছে পাঠাই, তাদের জানিয়ে দিই যে আমি যে কোনও মুহূর্তে হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারি।