ইসরায়েল যেভাবে গাজায় স্থল অভিযান চালাতে পারে
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার মধ্যে দিয়ে ফের শুরু হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। তারই ধারাবাহিকতায় গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে তেল আবিব। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারাও গাজাকে রক্ষায় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। দুই পক্ষেরই রয়েছে উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার পূর্ব অভিজ্ঞতা। একইসাথে উভয় পক্ষই ঘোষণা করেছে যে, তারা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে।
যুদ্ধরত উভয় পক্ষের মধ্যে ঠিক কোন পক্ষের বিজয় অর্জিত হবে, সেটি সময়ই বলে দেবে। তাই এই প্রশ্নটিকে একপাশে রেখে বর্তমানে আসন্ন স্থল অভিযান নিয়ে উভয় পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করা প্রাসঙ্গিক।
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যেক কমান্ডারই নিজ পক্ষের শক্তি এবং শত্রুর দুর্বলতা থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা করে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসও এক্ষেত্রে আলাদা নয়। উভয় পক্ষই একে অপরকে ভালোভাবে জানে এবং উভয়েরই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে। একইসাথে এটাও নিশ্চিত যে, উভয় পক্ষকেই তাদের মিত্ররা নিজস্ব রিসোর্স ও প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে।
এক্ষেত্রে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেনাদলটি বেশ প্রশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত। প্রায় ৫ লাখ ইউনিফর্ম পরিহিত সেনাদল ইসরায়েল ও দখলকৃত পশ্চিম তীরে অবস্থান করছে।
অন্যদিকে গাজার প্রতিরোধকামী দক্ষ সেনাদলের সংখ্যা মাত্র ১০ হাজারের মতো। শুধু এইসব যোদ্ধারাই যথাযথ প্রশিক্ষণ লাভ করেছে এবং নতুন প্রযুক্তির অস্ত্র ব্যবহার করে লড়াই করতে পারবে।
দুই পক্ষের তুলনায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সরঞ্জামের পরিমাণ এবং গুণমানে স্বাভাবিকভাবেই বেশি উন্নত। একইসাথে তারা বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ, শৃঙ্খলা অবলম্বন করা, নতুন সামরিক পদ্ধতি আত্মস্থ করা এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে কৌশলগতভাবে প্রতিপক্ষকে চমক দেখাতে সক্ষম।
বিপরীতে গাজার প্রতিরোধকামী যোদ্ধারা কাগজে কলমের হিসেবে বেশ দুর্বল। তবে তাদের রয়েছে নিজ ভূমি রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা।
একইসাথে গাজার যোদ্ধাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, তারা নিজেদের ভূমিতে লড়াই করবে। যার ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিটি প্রান্তই তাদের চেনা-জানা থাকবে। বিশেষ করে গাজার অধীনে হামাস বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার কিলোমিটারের যে সুদীর্ঘ টানেল খনন করেছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম।
বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব শীঘ্রই যে ইসরারেল স্থল অভিযান পরিচালনা করতে যাচ্ছে; সেটি প্রায় নিশ্চিত। তবে এক্ষেত্রে শুধু ইসরায়েলি শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক কমান্ডাররা হামলার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং সময় সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন। তবে তবুও সেক্ষেত্রে সার্বিক বিবেচনায় তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়।
ইসরায়েলের সেনাদল যে গাজায় রাতে আক্রমণ শুরু করবে; সেটা অনেকটা নিশ্চিত। বেশিরভাগ ইসরায়েলি সৈন্যরা এক্ষেত্রে অত্যাধুনিক নাইট-ভিশন চশমা ব্যবহার করতে পারে। একইসাথে অন্ধকারে দেখার জন্য তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণও রয়েছে। এছাড়াও ইসরায়েলি বিমান, ড্রোন, হেলিকপ্টার ইত্যাদিও সম্পূর্ণ অন্ধকারে বেশ কার্যকর।
বিপরীতে গাজার প্রতিরোধকারী সেনাদলেরও কিছু নাইট-ভিশন সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু রাতের বেলা অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের মতো বস্তুকে লক্ষ্য করে আঘাত করার ক্ষমতা তাদের ততটা নেই। এক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা অনেকটা এমন যে, কম উচ্চতায় একটি উড়ন্ত হেলিকপ্টারে হয়তো তারা সৌভাগ্যবশত আঘাত করতে পারে।
গাজা উপত্যকার সংকীর্ণ ভৌগোলিক আকৃতির কারণে বেশিরভাগ ইসরায়েলি বোমারু বিমান অঞ্চলটির আকাশসীমার বাইরে থেকেই তাদের মরণঘাতী পেলোড চালু করতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে তারা পূর্ব দিকের ইসরায়েলি ভূখণ্ড এবং পশ্চিম দিকের ভূমধ্যসাগরকে ব্যবহার করতে পারে।
গাজায় আক্রমণের সময় উপত্যকাটির পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বের আকাশসীমা ইসরায়েলি বিমানে ভরপুর হবে। একইসাথে বাহিনীটি প্রবেশের কয়েক মিনিট আগে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলি আক্রমণের মাধ্যমে গাজার যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করতে শুরু করবে।
তারই ধারাবাহিকতায় মোবাইল ফোনগুলোর নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ের বোমা হামলার মাধ্যমে যোগাযোগ টাওয়ারগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করা হবে। একইসাথে ভূমি ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা এবং টেলিফোন লাইনসহ অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ইলেকট্রনিকভাবে জ্যাম করা হবে এবং তাতে করে সেগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যাবে।
একইসাথে সম্ভবত রাতের দিকেই সমন্বিতভাবে স্থল এবং সমুদ্রপথেও আক্রমণ চালানো হবে। এতে করে জল, স্থল ও আকাশপথে ত্রিমাত্রিক আক্রমণের মুখে পড়বে গাজা। একইসাথে রাতে আক্রমণ চালালে ইসরায়েলের সেনাদল কমপক্ষে ছয় ঘণ্টার নাইট ভিশন সুবিধা পাবে। একইসাথে ঐ সময়টারে আরব বিশ্ব ও ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেও গভীর রাত থাকবে। একইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কর্মদিবস শেষের পর্যায়ে থাকবে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের স্থল বাহিনী গাজার চারপাশে নির্মিত বিচ্ছিন্ন প্রাচীরের মধ্য দিয়ে উপত্যকাটিতে প্রবেশ করবে। এক্ষেত্রে সাঁজোয়া বুলডোজার সকল বাধা ভেঙ্গে সামনে অগ্রসর হবে। একইসাথে গাজার যোদ্ধাদের স্থাপন করা অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইনগুলিকে ধ্বংস করবে।
ইসরায়েলের স্থল সেনাদলের সাথে থাকবে মেরকাভা ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া সেনাসহ পদাতিক বাহিনী। তাদের প্রথম উদ্দেশ্য হবে ভোরের আগেই বিল্ট-আপ এলাকায় পৌঁছানো। কারণ হামাসের প্রত্যাশিত প্রথম পাল্টা আক্রমণের আগে ইসরায়েলিরা গাজায় সুরক্ষিত এলাকায় অবস্থান করে দিনের যুদ্ধ শুরু করতে চাইবে।
ইসরায়েলি সামরিক চিন্তাভাবনা যতটুকু আঁচ করা যায়, তাতে গাজা আক্রমণের প্রথম রাতের মূল উদ্দেশ্য হবে সম্ভবত শহরটিকে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলা। যাতে করে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সাথে দক্ষিণাঞ্চল থেকে পুনরায় নতুন সেনাদল যুক্ত হতে না পারে।
অন্যদিকে ইসরায়েল কৌশল বিবেচনায় সমুদ্রের তীরে নৌ পদাতিক বাহিনী মোতায়ন করতে পারে। এক্ষেত্রে একটি সেনাদল খালি মাঠে মোতায়েন করে সেদিক থেকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।