জেরুজালেমের এ পর্বতচূড়ায় যে ক্যাফেটি সহাবস্থানের কেন্দ্র
হিব্রু ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ও বড়সড় একটি হাসপাতালের মাঝখানে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৩৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত অ্যারোমা এসপ্রেসো বার।
হাসপাতালের লোকজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা প্রায় এ ক্যাফেতে আসেন অবসর সময়ে।
গভীর বিভক্তির এ শহরে গত ২০ বছর ধরে এ ক্যাফেটি স্বতন্ত্র এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এটি যেন ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি মেডিকেল কর্মী এবং শিক্ষার্থীদের সহাবস্থানের এক চমৎকার স্থান।
এ ক্যাফেটির অবস্থান মাউন্ট স্কোপাসে। এ পর্বতের হিব্রু ও আরবি দুটো নামই আছে। হিব্রু ভাষায় পর্বতটির অর্থ 'প্রহরী পর্বত'। আর আরবিতে এটি 'পর্যবেক্ষণ পর্বত'।
গণিতের শিক্ষক মৃদুভাষী রানিয়া আবু আল-হাওয়া বলেন, এটি এমন একটি স্থান যেখানে সবাই 'আরাম করতে যেতে পারে, তারা যেখান থেকেই আসুক না কেন'।
'আমরা এখানে সবকিছু ভুলে যাই; ঘণ্টাখানেক এখানে কোনো রাজনীতির বিন্দুমাত্র লেশ থাকে না, তারপর আমরা বেরিয়ে পড়ি এবং আসল দুনিয়ার মুখোমুখি হই,' তিনি বলেন।
কিন্তু এসব ছিল সাম্প্রতিক ঘটনার আগে।
গত ৭ অক্টোবর হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে আচমকা হামলা করলে প্রায় ১,৪০০ ইসরায়েলি নিহত হন। এরপর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের পালটা বোমবর্ষণে এখন পর্যন্ত চার হাজার ১০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
অ্যারোমা'র কাউন্টারে কফি প্রস্তুত করছিলেন ফিলিস্তিনি কর্মী আহমাদ*। আরবি ভাষায় তিনি কফির অর্ডার নিলেন। এরপর এক দীর্ঘকায় ইসরায়েলি সেনাকে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি হিব্রুতে বাক্যালাপে ফিরে গেলেন।
আহমাদ জানান, কর্মক্ষেত্রে তার ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি দুই ধরনের বন্ধুই আছে। প্রতি সকালে একে-অপরের সঙ্গে দু-চারটে আলাপ করাও স্বাভাবিক বিষয়।
কিন্তু এখন ইসরায়েলি বন্ধুদের সঙ্গে আগের চেয়ে কম কথা বলে জানান আহমাদ। 'ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ,' তিনি বলেন।
আগের তুলনায় ক্যাফেটিতে এখন অভ্যাগতের সংখ্যা অনেক কম। একসময় যে চেয়ারগুলোতে বসে সামনে দামি খাবার নিয়ে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতেন শিক্ষার্থীরা, সেগুলো এখন কেবল খালি পড়ে আছে।
৪৪ বছর বয়সি ইসরায়েলি নাগরিক ড্যানি বলেন, এ ক্যাফেতে তার সবসময় দারুণ সময় কেটেছে, কারণ তিনি 'রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন'। আর এ ক্যাফেটাতে 'আরব ও ইহুদি সবাই যেতে পছন্দ করে'।
তিনি বলেন, এখানকার মানুষেরা নিজেদের কাজকর্ম নিয়েই বেশি ব্যস্ত। আর হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সব সময় ভালো সম্পর্কই বজায় থাকে।
আহমাদ জানান, এ ক্যাফের খাবারদাবার কোশার (ইসরায়েলিদের হালাল খাবার) নয়, অর্থাৎ এখানে যেসব ইসরায়েলি খেতে আসেন তারা অনেক বেশি অসাম্প্রদায়িক, অ-ইহুদিদের সঙ্গে মেশার বিষয়ে তুলনামূলক 'খোলা-মনের'।
২০টিরও বেশি চেইনশপের এ ক্যাফের বেশিরভাগ কর্মী ফিলিস্তিনি, তবে এর মালিকানা ইসরায়েলি। আর ক্যাফেটির কিছু লভ্যাংশ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে যায়।
এ কারণে এ ক্যাফেতে কাজ করা কিছু ফিলিস্তিনি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ভোগেন।
'কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কেন ওদের সেনাবাহিনীকে অর্থ দিতে সাহায্য করছ?' আহমাদ বলেন। 'কিন্তু এটা তো কেবল আমরা নই; প্রায় সব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানই সেটা করছে, এ যেমন ম্যাকডোনাল্ডসকে দেখুন না।'
সম্প্রতি ম্যাকডোনাল্ডস ইসরায়েল এর সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছে, এটি ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনীকে কয়েক হাজার খাবার বিনামূল্যে দিয়েছে।
এর আগে অ্যারোমা এসপ্রেসো বার ফিলিস্তিনি এলাকায় দোকান খুলতে চেয়েছিল, কিন্তু আহমাদ জানান আক্রমণের শিকার হওয়ার পর দোকানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ক্যাফেটির কর্মপরিবেশে প্রভাব ফেলেছে; এখানে কর্মীরা এসব ঘটনা নিয়ে মুখ বন্ধ রাখতেই বেশি পছন্দ করেন।
ইসরায়েলি কোম্পানির জন্য কাজ করা অনেক ফিলিস্তিনি, যারা আল জাজিরা'র সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদেরকে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন প্রকাশে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনি কর্মী ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কয়েক ডজন অভিযোগ পেয়েছে। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে তাদেরকে বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মস্থল থেকে হঠাৎ করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের পোস্ট এবং কিছুক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে তাদের কথোপকথনের দরুন তারা সাময়িক বরখাস্তের শিকার হয়েছেন।
*পরিচয়ের গোপনীয়তা রক্ষার্থে কিছু ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে