'ভ্রাম্যমাণ টেলিস্কোপ' চায় আকাশে তাদের স্বর্গের দেখা মিলুক!
জীবনের বাইশতম বছরে এসে সুসান মুরাবানার জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে; প্রথমবারের মতো টেলিস্কোপে চোখ রাখেন তিনি।
পাঠ্যবইয়ে শনিগ্রহ আর এর হলুদ-সোনালী বলয়ের যে ছবি এতোদিন দেখে এসেছেন, তা যেন চোখের সামনে সত্যি হয়ে ধরা দিলো তখন। প্রচণ্ড শক্তিশালী এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন সুসান।
'কসমস এডুকেশনে'র সাথে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জড়িত থাকার সুবাদে সুসানের এ অভিজ্ঞতা আস্বাদনের সুযোগ হয়। এটি একটি অলাভজনক সংগঠন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়নের জন্য নিবেদিত।
সংগঠনটির সাথে নিজের দেশ কেনিয়ার স্কুল ও গ্রামে ঘুরে শিশুদের শেখাতে শেখাতেই জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি ভালবাসা জন্মায় এই নারীর।
২০০৬ সালে মুরাবানা 'গ্লোবাল হ্যান্ডস-অন ইউনিভার্স' নামে একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে মহাকাশ শিক্ষা প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন।
চার বছর পর অনলাইনে অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক ইউনিভার্সিটি থেকে মহাকাশবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন তিনি, এরপরই 'শর্ট টার্ম স্কলার' হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে ডাক পান। সেখানে গিয়ে বুঝতে পারেন, মার্কিন শিশুদের মতো আফ্রিকার শিশুদের কাছেও এ বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ তৈরী করে দেয়া কতোটা প্রয়োজন।
"আমি এমন কিছু চেয়েছিলাম যা টেকসই হবে এবং কেনিয়ান সম্প্রদায় পছন্দ করবে।"
ট্রাভেলিং টেলিস্কোপ
২০১৪ সালে সুসান মুরাবানা এবং তার স্বামী ড্যানিয়েল চু ওয়েন মিলে স্থাপন করেন 'ট্রাভেলিং টেলিস্কোপ'।
এটি আসলে একটি শিক্ষামূলক কর্মসূচী যা অনুন্নত এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
মাত্র একটি টেলিস্কোপ আর ভাসমান প্ল্যানেটেরিয়ামের সাহায্যে তারা শিশুদের শনি, চাঁদ এবং নক্ষত্ররাজি দেখার সুযোগ করে দেন; এর মাধ্যমে শিশুরা শেখে বিজ্ঞানের মৌলিক নানা দিক আর জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান (অ্যাস্ট্রোফিজিক্স)।
"স্কুলে গিয়ে, শিশুদের সাথে কথা বলে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যাশা দেখতে পেলে সত্যিই তৃপ্তি পাওয়া যায়", বলেন সুসান।
"পূর্ব কেনিয়ার ১২ বছর বয়সী এক ছেলে যেমন আমাদের বলেছিল, 'আমি ভাবতাম বিজ্ঞানীরা মিথ্যা বলেন, কিন্তু এখন আমি বিজ্ঞানে বিশ্বাস করি।"
পরিবর্তনের শুরু
মুরাবানা এবং ওয়েন মহাকাশ শিল্পে যুক্ত হতে কেনিয়ানদের অনুপ্রাণিত করতে চান; মহাকাশে প্রথম কেনিয়ান নভোচারীকে দেখার স্বপ্ন তাদের।
ওয়েন বলেন, অধিকাংশ কেনিয়ান জানেনও না যে দেশটি মহাকাশ গবেষণায় জড়িত। অথচ ২০১৮ সালে কেনিয়া স্পেস এজেন্সি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে কক্ষপথে প্রথম স্যাটেলাইট স্থাপন করে। এছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব কেনিয়ার উপকূল মালিন্দিতে স্থাপিত উপগ্রহ কেন্দ্রটি স্যাটেলাইট ট্র্যাকিংয়ের জন্য ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি ব্যবহার করে থাকে।
মুরাবানা বিশ্বাস করেন শুধু জ্যোতির্বিদ্যা নয়, নিছক আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আমাদের এই গ্রহটিকে রক্ষা করার জন্য একটি সচেতনতা তৈরী হয় মনে; এতে পরবর্তী প্রজন্মও আরও সচেতন হয়ে উঠবে।
"তারা বলেন,মহাকাশচারীরাই প্রথম পরিবেশবাদী ছিলেন। কারণ তারাই প্রথম গ্রহটিকে পুরোপুরি দেখতে পান। আমরা সেটিই বাড়ি নিয়ে আসছি- মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটি আমাদের নিজেদের গ্রহটিকেও আরও বেশি বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখতে সাহায্য করে।"
তবে মুরাবানার কাজের পেছনে আরও একটি প্রেরণা রয়েছে - জ্যোতির্বিদ্যা যে পশ্চিমা বিজ্ঞান, সে ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করা।
যখন তিনি কসমস এডুকেশনের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন, তখন দলটিতে যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা স্নাতকের অনেক শিক্ষার্থী ছিলেন কিন্তু আফ্রিকার কেউ ছিল না। সুসানের মনে হচ্ছিল, তিনি যেন এই দলের বাইরে।
বছর কয়েক পর ঘানায় 'আফ্রিকান কালচারাল অ্যাস্ট্রোনমি' থিমের একটি সূর্যগ্রহণ দেখার উৎসব এবং সংশ্লিষ্ট সভায় গেলে তার এ উপলব্ধি পরিবর্তিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকার জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো এবং এতে প্রাচীন মিশরীয় এবং মালির ডোগন সম্প্রদায়ের যোগ রয়েছে।
"জ্যোতির্বিদ্যার জন্য যা কিছুই পাচ্ছিলাম, সবই ছিল পশ্চিমা উদ্ভুত; এখনও আফ্রিকান সংস্কৃতি থেকে আসা জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক কোনো বই নেই আমাদের", ব্যাখ্যায় বলেন সুসান।
"এই সভায় গিয়ে আমি উপলব্ধি করেছি যে আমিও এখানে আছি এবং আফ্রিকানরাও এর একটি অংশ।"
কসমিক হিল
আলোক দূষণ থেকে দূরে কেনিয়াতে এক টুকরো জমি কিনবেন এই জুটি, যেখানে গড়ে তোলা হবে 'কসমিক হিল'।
"আমি সেখানে একটি মানমন্দির তৈরি করতে চাই," বলেন ওয়েন।
"আমি চাই মহাকাশ সম্পর্কে জানতে, কিংবা উল্কাপাত দেখতে মানুষ আসুক এখানে। আমরা সামান্য ভিত্তি চাই,যেখানে বসে আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।"
এখন পর্যন্ত ৪ লাখের বেশি মানুষ 'ট্র্যাভেলিং টেলিস্কোপে'র মাধ্যমে মহাকাশ দেখার যাত্রায় সামিল হয়েছে। এই জুটির ইচ্ছা আরও অধিক সংখ্যক স্কুলে তাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া।
মুরাবানা স্বপ্ন দেখেন, "প্রতিটি শিশু তাদের জীবনে অন্তত একবার হলেও যেন রাতের আকাশের পাঠ নেয়ার সুযোগ পায়।"