দিনে ১০ হাজার বার ঘুম: যেভাবে মাইক্রোস্লিপের মাধ্যমে বেঁচে আছে চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইন
মাত্র চার সেকেন্ড ঘুম, এরপর জেগে ওঠা, তারপর আবার চার সেকেন্ডের ঘুম, আবার জেগে ওঠা। এভাবে রাত কাটিয়ে দেওয়া আপনার কাছে এক ধরনের অত্যাচারই মনে হতে পারে। তবে এটি চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনের কাছে স্বাভাবিক বিষয়। কারণ এরা দিনে অন্তত কয়েক হাজার বার ঘুমায়। আর এদের ঘুমও মাত্র চার সেকেন্ডের। বিষয়টি আশ্চর্যের মনে হলেও নতুন এক গবেষণার পর এ তথ্যই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের কিং জর্জ দ্বীপের বাসিন্দা এ পাখিদের ওপর গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এরা দিনে ১০ হাজারেরও বেশি বার ঘুমায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়েক সেকেন্ডের এ ঘুম ও জেগে ওঠার মধ্য দিয়ে তারা তাদের নীড়, ডিম এবং বাচ্চাদের শিকারির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সতর্ক নজর রাখে।
লিয়ন নিউরোসায়েন্স রিসার্চ সেন্টারের প্রধান গবেষক পল-অ্যান্টোইন লিবোরেল বলেন, 'মানুষ এই অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু পেঙ্গুইনরা পারে। বেশিরভাগ পাঠ্যপুস্তকে আমরা যা পড়ে থাকি তার চেয়ে ঘুমের বৈচিত্র্য অনেক বেশি জটিল।'
১৯৮০-এর দশকেও গবেষকরা পেঙ্গুইনের ঘুম নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তখন তারা এসব পাখির ক্ষণস্থায়ী ঘুমের বিষয়টি লক্ষ্য করেন। তারা এটিকে 'তন্দ্রা' হিসেবে চিহ্নিত করেন। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষণস্থায়ী এই ঘুমের বিষয়টি পুরো দিন জুড়ে ঘটে থাকে।
গবেষণাটি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে গবেষকরা বলেছেন, 'প্রজনন পর্যায়ে থাকা চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনগুলোকে স্থলে যেকোনো পরিস্থিতি ও অবস্থানে এমন ক্ষণস্থায়ী দশায় ঘুমাতে অনেক বেশি দেখা গেছে। ঘুমের সময় শরীরে যেসব কার্যক্রম ঘটে থাকে, মাইক্রোস্লিপ সেগুলোর অন্তত কিছুটা পূরণ করতে পারে।' যেসব পেঙ্গুইনের উপর এ গবেষণা চালানো হয়েছে সেগুলো দাঁড়িয়ে বা শুয়ে উভয়ভাবেই ঘুমাতে পারে।
সব প্রাণীর মধ্যেই ঘুমের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়। কিন্তু এই ঘুম শিকারে পরিণত হওয়ার জন্য তাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। কারণ তখন তারা বাইরের পরিবেশে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না।
লিবোরেল বলেছেন, 'ঘুমের সঙ্গে প্রাণীর আচরণের বিষয়টি জড়িত। এই ঘুমের সময় নির্বাচন করা নিয়েও প্রাণীগুলোর মধ্যে একটা চাপ থাকে। ঘুম নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণাই করা হয়েছে মানুষ ও ইঁদুরের ওপর। তবে অন্যান্য প্রজাতির উপর গবেষণায় পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে ঘুম প্রভাবিত হওয়ার পর্যায় লক্ষ্য করা গেছে।'
গবেষকরা ইলেক্ট্রেএনসেফেলোগ্রাম (ইইজি) পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজের সাহায্যে বুনো চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনগুলোর উপর গবেষণা করেছেন। ঘুম-সম্পর্কিত মস্তিষ্কের কার্যকলাপ এবং চোখ বন্ধ করে রাখার ধরন দেখে গবেষকরা পেঙ্গুইনগুলোর মাইক্রোস্লিপের বিষয়টি লক্ষ্য করেন। দুপুরের দিকে পেঙ্গুইনগুলো ঘুমের গভীরতা কিছুটা বেশি দেখা গেছে। কারণ সে সময়ে শিকারির আক্রমণের ঝুঁকি অনেক কম।
চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনের ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকদের একজন যখন দূরে কোথাও খাবার সংগ্রহের জন্য যায়, সেই সময়টাতে অন্য সঙ্গী বাসায় বসে থাকে। বেশি সময় ধরে ঘুম তাদের ডিম বা বাচ্চাদের বাদামী স্কুয়া পাখি বা অন্যান্য পেঙ্গুইনদের আক্রমণ বা শিকারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
গবেষকরা দুই হাজার ৭০০টিরও বেশি প্রজনন জোড়ার উপনিবেশের মধ্যে ডিম ফোটাতে থাকা ১৪টি পেঙ্গুইনের ওপর গবেষণা করে দেখেন, এই পাখিরা হাজার হাজার মাইক্রোস্লিপ করছে, যেসবের স্থায়িত্ব মাত্র চার সেকেন্ড, যা নজিরবিহীন। তারা অন্যান্য পেঙ্গুইনের মধ্যেও এ প্রবণতা লক্ষ্য করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু প্রজাতি নিয়মিতভাবেই খুব কম ঘুমায়। আফ্রিকান বুশ হাতিরা দিনে গড়ে দুই ঘণ্টা ঘুমায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের এই ঘুম হয় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতে। কখনও কখনও তারা ঘুম ছাড়া ৪৮ ঘণ্টা।কাটিয়ে দেয়।
গবেষণায় লিঙ্গভেদে কিছু প্রজাতির মধ্যে ঘুমের পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। যেমন পুরুষ ফ্রুট-ফ্লাইদের দিনে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় ঘুমের প্রয়োজন হয়। যেখানে স্ত্রী ফ্রুট-ফ্লাইগুলো চার ঘণ্টার বেশি ঘুমায় এবং ১৫ মিনিটেরও কম ঘুমিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।