চ্যাটজিপিটি ব্যবহারে সাপ্তাহিক কর্মদিবস চারদিনে নেমে আসবে: নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ পিসারাইডস
গতবছরের ৩০ নভেম্বর উন্মুক্তের পর থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছে। বিশেষ করে চাকরির বাজারে এর প্রভাব নিয়ে বহু প্রযুক্তিবিদ নানা ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। যার মধ্যে আগামী বছরগুলোতে বিশাল সংখ্যক মানুষের চাকরি হারানো থেকে শুরু করে কাজের ধরনে পরিবর্তন আনার মতো ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অন্যতম।
ঠিক তেমনি একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের প্রফেসর ক্রিস্টোফার পিসারাইডস। তিনি শ্রম অর্থনীতি এবং অটোমেশন প্রভাব নিয়ে কাজ করে থাকেন।
গত এপ্রিল মাসে পিসারাইডস অনুমান করেন, জেনারেটিভ এআই কর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে আরও বেশি উত্পাদনশীল করতে সক্ষম হবে। ফলে কাজের জন্য তাদের কম সময় ব্যয় করতে হবে। সহজভাবে বলতে গেলে, চ্যাটজিপিটির মতো এআই টুলের সাহায্যে সপ্তাহে মাত্র চারদিন কাজ করার রীতি বিস্তৃত পরিসরে চালু হতে পারে।
এরপর বহু সময় গড়িয়েছে। নতুন নতুন এআই চ্যাটবট বাজারে আসা থেকে শুরু করে প্রযুক্তিটির সেইফটি রেগুলেশন নিয়েও বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এমতাবস্থায় পিসারাইডস আরও নিশ্চিতভাবে মনে করেন, তার সপ্তাহে চারদিন কাজ করার ভবিষ্যদ্বাণীই যেন সত্যি হতে যাচ্ছে।
ফরচুন এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিসারাইডস বলেন, "এখন আমি বিশ্বাস করি, চ্যাটজিপিটি কাজের মান উন্নত করবে এবং সম্ভবত উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি করবে।" একইসাথে সপ্তাহে চারদিন কাজের বিষয়টিকে এখন আরও বেশি যৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।
পিসারাইডস যে শুধু একা এমন ভবিষ্যদ্বাণী করছে বিষয়টি এমন নয়। বরং থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অটোনমি-এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, কীভাবে এআই-চালিত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চার দিনের কর্মসপ্তাহ শুরু হতে পারে।
অন্যদিকে বিখ্যাত বিনিয়োগকারী রে ডালিও এআই আরও ব্যাপকভাবে গৃহীত হওয়ার কারণে সপ্তাহে কর্মদিনের সংখ্যা কমে আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। একইভাবে জেপি মরগ্যান চেজ-এর সিইও জেমি ডিমনের মতেও কর্মীরা ভবিষ্যতে সপ্তাহে হয়তো মাত্র ৩.৫ দিন কাজ করবেন।
যদিও বর্তমানে এআইয়ের উন্নতি সপ্তাহে কর্মদিবস ক্রমে কমে আসার সম্ভাবনার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে বেতনের উপর এআইয়ের প্রভাব কেমন হবে সেটি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। পিসারাইডস মনে করেন, কর্মক্ষেত্রে সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমে আসলেও বেতন কমে যাওয়ার আশঙ্কা খুব শীঘ্রই নেই।
পিসারাইডস বলেন, "উৎপাদনশীলতার উন্নতির কারণে বেতন কমবে না। তবে চ্যাটজিপিটিকে কাজে লাগিয়ে কাজগুলি দ্রুত সম্পন্ন হবে। আমরা অনেক চাকরিতে পাঁচ দিনে যা করছি তা চার দিনে করতে পারব।"
২০১০ সালে আরও দুইজন একাডেমিক ব্যক্তিত্বের সাথে পিসারাইডস বেকারত্বের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে তাদের গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মনে করেন, পূর্বের অটোমেশন প্রযুক্তি যেমন রোবোটিক্স শুধুমাত্র মানব শ্রমের উপর নির্ভর করার চেয়ে আরও ভাল ফলাফল দেবে বলে আশা করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, "আমরা সর্বদা বিশ্বাস করি যে, অটোমেশন প্রযুক্তিগুলি উত্পাদনশীলতাকে আরও বৃদ্ধি করবে। একইসাথে এগুলো সময়ের সাথে সাথে আরও ভালো করার জন্য যথেষ্ট উন্নতি লাভ করবে। তবুও অটোমেশন যন্ত্রপাতিগুলো শুধু দীর্ঘকাল ধরে এই 'শঙ্কা' জাগ্রত করেছে যে, এটি চাকরির একটি বড় অংশ দখল করে নেবে।"
এআই নিয়েও যেন ঠিক একই ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, এআইয়ের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ৩০০ মিলিয়ন চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
শুধু চাকরি হারানোই নয়, বরং এআইয়ের অপব্যবহারও বেশ শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তিবিদেরাও এ নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন।
এমনকি 'গডফাদার অব এআই' খ্যাত গুগলের সাবেক কর্মকর্তা জিওফ্রে হিন্টন মনে করেন, ক্ষতিকারক উদ্দেশ্যে প্রযুক্তিটি ব্যবহার করার বিষয়টিকে প্রতিরোধ করা কঠিন হতে পারে। একইসাথে ভবিষ্যতে এআই মানুষকে ম্যানিপুলেট করতে পারে এবং সম্ভাব্যভাবে তাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তবে এখনই এমন আশঙ্কাকে নাকচ করে দিয়ে পিসারাইডস বলেন, "এআই সম্পর্কে এখনই এই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। কারণ প্রযুক্তিটি সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনও অজানা। এআই ভিন্ন; কারণ এটি পরবর্তী কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কে আরও অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। একইসাথে এর ক্ষমতা সম্পর্কেও অনিশ্চয়তা রয়েছে।"
প্রকৃতপক্ষে এআই ভালো ও খারাপ উভয় কাজেই ব্যবহার করা যায়। ব্যবসায়িক জগতের অনেকেই মনে করে যে, এটি হয়তো মানুষের নানা কাজের বেশ কার্যকরী সহযোগী হবে।
প্রযুক্তি জায়ান্ট আইবিএম-এর সিইও অরবিন্দ কৃষ্ণ চলতি বছরের শুরুর দিকে লিখেছিলেন যে, এআইয়ের সাহায্যে অধিকাংশ লোকের কাজগুলিকে পুনরাবৃত্তি করার মতো যে সমস্যা রয়েছে, সেগুলোকে সমাধান করবে। যা কর্মীদের অনেক বেশি কাজ করার ঝামেলা থেকে মুক্ত করে।"
চ্যাটজিপিটি বাজারে উন্মুক্ত হওয়ার পর খুব অল্প সময়েই কর্মক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ সম্পর্কে পিসারাইডস বলেন, "আমরা কর্মক্ষেত্রে যে কাজগুলো করি সেগুলোর সাথে চ্যাটজিপিটির সক্ষমতা বেশ গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।"
আগে এআই টুলগুলি ব্যবহার করার জন্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উচ্চ মাত্রার কম্পিউটিং শক্তি প্রয়োজন ছিল। তাই কোম্পানিগুলির জন্য এই ধরনের প্রযুক্তিগুলির সাথে মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন ছিল।
এ সম্পর্কে পিসারাইডস বলেন, "নিয়োগকর্তারা নিজেদের কর্মীদের সহকারী হিসাবে প্রযুক্তিটির ব্যবহার সম্পর্কে আরও আশাবাদী হতে শুরু করেছে। এটা বেশ ভালো কাজের ক্ষেত্র তৈরি করবে। কর্মীরাও বেশ সন্তুষ্ট থাকবে।"
পিসারাইডস মনে করেন, এআই উৎপাদনশীলতার মানদণ্ডে পৌঁছাতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। যদিও পিসারাইডস সতর্ক করেছেন যে, এক্ষেত্রে আরও প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নীতির প্রয়োজন হবে৷
বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের এক গবেষণায় দেখা যায়, এআইয়ের ব্যবহারের ফলে সৃজনশীল সব কাজে নির্ধারিত কিছু গ্রুপের কর্মক্ষমতা ৪০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও ব্যবসায়িক সমস্যা সমাধানের এআই শতকরা ২৩ ভাগ বেশি ভালো ফলাফল দিচ্ছে।