হিথ্রো বিমানবন্দরের চেয়েও ছোট জায়গায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ!
ইসরায়েল গাজায় সামরিক হামলা বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছে। এমতাবস্থায় দেশটির সেনাবাহিনীর (আইডিএফ) পক্ষ থেকে উপত্যকাটির প্রায় ২০ লাখ বেসামরিক মানুষকে বারবার আল-মাওয়াসি নামের 'মানবিক অঞ্চল' এ চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। অথচ ঐ অঞ্চলটি আয়তনে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের চেয়েও ছোট। খবর বিবিসির।
আল-মাওয়াসি মূলত ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত একটি সরু অঞ্চল। এটিতে নামমাত্র কয়েকটি ভবন রয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগ অংশই মূলত বালুময় টিলা এবং কৃষি জমি নিয়ে গঠিত।
আল-মাওয়াসিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিরাপদ অঞ্চল বলে ঘোষণা করেছে। যদিও মাত্র ৮.৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এলাকাটিতে শরণার্থীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা।
প্রাণে বাঁচতে তথাকথিত মানবিক অঞ্চলটিতে আশ্রয় নিয়েছেন রিম আবদ রাবু নামের এক ফিলিস্তিনি। তিনি গত কয়েক সপ্তাহ মাটিতে ঘুমিয়েই কাটিয়েছেন। এলাকার আরও চারটি পরিবারের সাথে তিনি একটি তাঁবু ভাগ করে থাকছেন। গত ৭ অক্টোবর থেকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর উপত্যকাটির ১৮ লাখ মানুষ ঠিক এমনভাবেই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর রিম প্রথমে উত্তর গাজা থেকে পালিয়ে খান ইউনিসের চলে যান। কিন্তু সেখানে আশেপাশের বাড়িগুলোতে ক্রমাগত বোমাবর্ষণ হওয়ার ফলে তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্দেশকৃত আল-মাওয়াসিতে আশ্রয় নেন।
বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে রিম জানান, তিনি ভেবেছিলেন আল-মাওয়াসি তীব্র বোমাবর্ষণ ও যুদ্ধ থেকে নিরাপদ জায়গা হবে। কিন্তু আসার পর এখানে সামান্য কোনও মৌলিক সেবা পর্যন্ত তিনি খুঁজে পাননি। এটি মূলত একটি পরিত্যক্ত জায়গা। যা মানুষের থাকার জন্য উপযোগী নয়।
রিম বলেন, "১০ দিনে পানি একবারের জন্য আসে। এমনকি বাথরুমগুলোতেও একই অবস্থা। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও চলছে একই নিয়ম।"
যদিও গত ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইডিএফ অন্তত ১৫ বারের মতো গাজার বেসামরিক নাগরিকদের আল-মাওয়াসিতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই সংক্রান্ত প্রথম নির্দেশনাটি দেওয়া হয় গত ১৮ অক্টোবর মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এ।
পোস্টে বলা হয়, "আইডিএফ গাজার বাসিন্দাদের আল-মাওয়াসি এলাকার মানবিক অঞ্চলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। যেখানে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা পাঠানো হবে।"
২১ অক্টোবর আরেকটি পোস্টে বলা হয়, "যদি আপনার জীবন এবং আপনি যাদের ভালবাসেন তাদের জীবন আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে ওয়াদি গাজার দক্ষিণে চলে যান। আমরা আপনাকে নির্দেশনা অনুসারে মাওয়াসির মানবিক এলাকায় পৌঁছানোর পরামর্শ দিচ্ছি।"
ইন্টারনেটের তীব্র সংকট গাজার অন্য অঞ্চলগুলোতে বসবাসের অনেকটা অনুপযোগী করে ফেলেছে। এদিকে আল-মাওয়াসি নিয়েও আইডিফের নির্দেশনায় বেশ কয়েকবার পরিবর্তন এসেছে। বেসামরিক নাগরিকেরা জানায়, প্রতিনিয়ত নির্দেশনায় পরিবর্তন আনার ফলে ঠিক কোথায় গেলে তারা নিরাপদে থাকবেন সেটি তারা বুঝতে পারছেন না।
আইডিএফের প্রতিটি পোস্টে মানচিত্রে আল-মাওয়াসির পৃথক পৃথক সুনির্দিষ্ট ছোট অঞ্চল দেখিয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত এই মানবিক অঞ্চলের অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে।
আল-মাওয়াসিতে আশ্রয় নেওয়া এক শরণার্থী মোনা আল-আসতাল। আশেপাশে গোলাগুলির শব্দে তিনি সারা রাত ঘুমাতে পারেন না। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। তার প্রতিবেশীর বাড়িতে বোমা হামলার পর বাধ্য হয়ে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল তাকে।
মোনা জানান, মানবিক অঞ্চলটিতে নেই পানি, বিদ্যুৎ ও খাবারের সরবারাহ। এমনকি তাকে ৩০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে একটি তাবু ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে হয়েছে।
মোনা নিজ চোখে জাতিসংঘের খাদ্যের গুদাম ভেঙ্গে মানুষকে খাবার নিতে দেখেছেন। কেননা তারা চরম মাত্রায় ক্ষুধার্ত ছিলেন। খাওয়ার মতো কিছুই তাদের কাছে ছিল না।
মোনা জানান, উকুন, চিকেন পক্স ও অন্ত্রের সংক্রমণের মতো রোগগুলি শিশুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যাওয়ায় অবস্থা আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, অঞ্চলটিতে থাকার ঝুঁকি ততই বাড়ছে।
মোহাম্মদ ঘানেম নামের এক ব্যক্তি উত্তর গাজার আল-শিফা হাসপাতালের পাশেই বসবাস করতেন। তার বাড়ির আশেপাশে প্রায় ২৫ টি হামলা হওয়ার পর তিনি আল-মাওয়াসিতে এসে আশ্রয় নেন।
ঘানেম বলেন, "ইসরায়েলি সেনাবাহিনী লোকজনকে এখানে আসার নির্দেশ দিচ্ছে। কিন্তু এলাকাটি মানবিক বা নিরাপদ কোনটিই নয়।"
ঘানেম জানান, মানবিক অঞ্চলটি থেকে ইসরায়েলি ট্যাঙ্কগুলি এক কিলোমিটারেরও কম দূরে অবস্থান করছে। এমনকি মাত্র ৫০০ মিটার দূরের একটি এলাকায় হামলাও হয়েছে।
অন্যদিকে গত ৬ ডিসেম্বর আইডিএফ দাবি করে যে, মানবিক অঞ্চল থেকে হামাস ইসরায়েলের দিকে একটি রকেট নিক্ষেপ করেছে। সেখানে মানচিত্রে যে অঞ্চলটি নির্দেশ করা হয়েছিল সেটি আল-মাওয়াসি। তবে বিবিসির পক্ষ থেকে এমন দাবির সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি গাজার মানবিক অঞ্চলগুলির কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কেননা অঞ্চলগুলোর অধিকাংশ জায়গাতেই যুদ্ধ ও বিমান হামলা চলছে।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, আল-মাওয়াসিকে মানবিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা হবে একটি 'বিপর্যয়'।
সংস্থাটির প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইসাস বলেন, "অল্প পরিষেবার সুযোগ থাকা ছোট অঞ্চলটিতে এতগুলি লোককে আটকানোর চেষ্টা করলে তা ঐ লোকেদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে। ইতিমধ্যেই তারা এই ঝুঁকিতে রয়েছেন।
এছাড়াও জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও মানবিক অঞ্চলগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ইউএন অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অফ হিউম্যানটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের প্রধান আন্দ্রেয়া ডি ডোমেনিকো বলেন, "গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ; কেউ এবং কোন জায়গা নিরাপদ নয়। একতরফাভাবে ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চল বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করতে পারছে না।"