যে কারণে আপনি সহজেই আর কাশ্মীরের বিখ্যাত আপেল পাবেন না
তীব্র ঠাণ্ডা আর ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক শীতের সকালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার একটি ফলের বাজারে শতাধিক আপেল চাষীর দেখা মিলল। বাজারটিতে টিনের তৈরি ছোট্ট গুদামে তারা নিজেদের চাষ করা আপেল মজুদ করে রেখেছেন। সেগুলো ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির জন্য তীব্র শীতের মধ্যেও সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে ছত্রাকের সংক্রমণের কারণে এবার আপেলের মান আশানুরূপ হয়নি। তাই চাষীরা কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাবেন কি না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। খবর বিবিসির।
আপেল উৎপাদনের জন্য ভারতজুড়ে এ অঞ্চলটির বেশ খ্যাতি রয়েছে। এ অঞ্চলে নানা জাতের আপেল চাষ হয়ে থাকে। তবে ছত্রাকের ব্যাপক সংক্রমণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এ অঞ্চলের উন্নয়নশীল এই শিল্পটিকে সংকটজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে।
আকার, মান ও রঙভেদে আপেলকে এ, বি ও সি- এই তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এ ক্যাটাগরিতে রয়েছে সবদিক থেকে সবচেয়ে ভাল আপেলগুলো। ছত্রাকে সংক্রমিত আপেলগুলো রয়েছে বি ও সি ক্যাটাগরিতে। দুটি ক্যাটাগরিই ছত্রাক সংক্রমিত হলেও সি ক্যাটাগরির তুলনায় বি ক্যাটাগরির আপেল কম সংক্রমিত।
পুলওয়ামার ফলচাষী ও বিক্রেতা গুলাম নবী মীর বলেন, 'এবার উৎপাদিত মোট আপেলের প্রায় ৪০ শতাংশ সি-গ্রেডের।'
শ্রীনগরভিত্তিক অর্থনীতিবিদ এজাজ আইয়ুব জানান, হিমালয় ঘেঁষা এ অঞ্চলটি বছরে ২০ লাখ টন আপেল রপ্তানি করে থাকে। এ খাত থেকে বার্ষিক রাজস্ব আয় ১২০ বিলিয়ন রুপি (১.৪৪ বিলিয়ন ডলার), যা কি না এ অঞ্চলের পর্যটন খাতের রাজস্ব আয়ের প্রায় দ্বিগুণ।
তবে অস্বাভাবিক আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে এবার আপেল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এজাজ আইয়ুব বলেন, এপ্রিল-মে মাসের অ-মৌসুমে হওয়া বৃষ্টিপাতের কারণে আপেলগুলো ছত্রাকে সংক্রমিত হয়েছে। কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহার করলেও বৃষ্টির পানিতে সেই কীটনাশকও ধুয়ে গেছে।
শের-ই-কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. তারিক রাসুল জানান, চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি আপেলগুলোর আকার, মান এবং পরিমাণেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
কাশ্মীরের বুদগাম জেলার চাদুরা এলাকার ৫৮ বছর বয়সী কৃষক গুলাম মোহাম্মদ বাত জানান, তিনি এ অঞ্চলে এমন জটিল আবহাওয়া পরিস্থিতি এর আগে কখনোই দেখেননি। তিনি বলেন, 'মে মাসের শিলাবৃষ্টিতে আমার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেই সঙ্গে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমের কারণে পর্যাপ্ত পানির ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে আপেলগুলোর রঙও ভাল হয়নি।'
বাত পাঁচ একরেরও বেশি জমিতে আপেল চাষ করেছেন। তার জমির অর্ধেকেরও বেশি আপেল গাছ ছত্রাকে সংক্রমিত হয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের আবহাওয়া বিভাগের তথ্যমতে, পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল কাশ্মীর উপত্যকায় মারাত্মক আবহাওয়ার ঘটনা গত সাত বছরে বেড়েছে।
২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে চরম আবহাওয়াজনিত কারণে জম্মু ও কাশ্মীরে সাড়ে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন।
২০২১ সালের জুলাই মাসটি কাশ্মীরের জন্য ছিল এর আগের আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ মাস। ওই মাসের ১৮ তারিখ রেকর্ড তাপমাত্রা (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) প্রত্যক্ষ করে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। একই বছরের জানুয়ারিতে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ঠাণ্ডা রাতের অভিজ্ঞতাও হয়েছিল তাদের।
চরম আবহাওয়ার কারণে শস্য পরিবহনেও কৃষকদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। কৃষকরা শরৎকালে জমি থেকে ফসল সংগ্রহ শুরু করলেও মহাসড়কে ভূমিধ্বসের আশঙ্কায় ফসলগুলো বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের জন্য শীতের মৌসুম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় তাদের।
শ্রীনগর-জম্মু জাতীয় মহাসড়কটি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের একমাত্র সড়ক। ভূমিধস হলে সড়কটিতে আপেল বোঝাই কয়েক শ ট্রাক আটকে পড়ার দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির আজাদপুর ফল বাজারের কাশ্মীরি আপেল ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি বিজয় টায়রা বলেন, ভারতে ফলের বাজারে ইরানের আপেলের উপস্থিতি বাড়ছে। এ কারণে বাজারে কাশ্মীরি আপেলের দখল ও এর মূল্য কমছে বলে জানান দেশিয় চাষীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, দুই সপ্তাহ আগেও মানভেদে এক বাক্স আপেল এক হাজার থেকে এক হাজার ৩০০ রুপিতে বিক্রি হয়েছে। এখন এক বাক্স আপেল বিক্রি হচ্ছে ৮০০ রুপিতে, যাতে কি না ব্যবসায়ীদের ন্যূনতম খরচটিও উঠছে না।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আপেল আমদানিতে ভারত সরকারের ২০ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কারণেও দাম পড়ে গেছে দেশিয় আপেলের। এতে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা।
গত নভেম্বরে এ সংকট সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ কামনা করে চিঠি দেয় কাশ্মীর ভ্যালি ফ্রুট গ্রোয়ারস কাম ডিলার ইউনিয়ন (কেভিএফজি)।
ভেজাল কীটনাশক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেও উদ্বিগ্ন কৃষকরা।
বাত জানান, কীটনাশক নির্ভরযোগ্য মানের হলে বাগানেও ছত্রাকের সংক্রমণ কম হবে।
তবে জম্মু ও কাশ্মীরের উদ্যানবিদ্যা বিভাগের উপ-পরিচালক শাফিকা খালিদ বলেন, 'অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করা হয়েছে।'
তিনি আরো বলেন, সমস্যাটি তখনই দেখা দেয়, যখন কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহারের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গুরুত্ব দেয় না।