কুকুরের কথা ভুলে যান: ইঁদুরই হতে পারে উদ্ধারকাজের ভবিষ্যৎ
উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত প্রাণীর কথা মাথায় এলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কমলা রঙের ভেস্ট পরা কুকুরের ছবি। তবে বেলজিয়ামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আমাদের চোখের সামনে কুকুরের বদলে আফ্রিকার বৃহৎ পাউচড ইঁদুর। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আপোপোতে কর্মরত ডোনা কিন এবং তার সহকর্মীরা পাউচড ইঁদুরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য। গত ২০ বছর ধরে তারা এই উৎসাহী প্রাণীগুলোকে (ক্রিকোটেমিস এনসোরজেই) নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন যক্ষ্মারোগী খুঁজে বের করা এবং ল্যান্ড মাইন শনাক্ত করার জন্য। এখন তারা ইঁদুরগুলোকে দিয়ে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করাতে চান।
সাইন্স কিনের সঙ্গে তারা এই নতুন প্রজেক্ট 'রেসকিউর্যাটস' এর ব্যাপারে কথা বলেছেন। স্বচ্ছতা রক্ষার্থে এবং এর দৈর্ঘ্য ঠিক রাখার জন্য সাক্ষাৎকারটি সম্পাদনা করা হয়েছে।
প্রশ্ন: কুকুরের বদলে ইঁদুরকে ধ্বংসস্তূপে কেন পাঠানো হবে?
উত্তর: ইঁদুরের ঘ্রাণশক্তি চমৎকার, আর এদেরকেও কুকুরের মতো প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। এরাও শুধু একজন প্রশিক্ষকের কাছে বাধ্য থাকে না যেটা কুকুরের ক্ষেত্রেও বেশ দেখা যায়। এই ইঁদুরের আকৃতিও এক্ষেত্রে বেশ সুবিধাজনক, কারণ এরা সহজেই ভারী ধ্বংসস্তূপ কিংবা ধ্বংসাবশেষের এমন জায়গা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে যেটা কুকুরের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের কাছে থাকা ইঁদুরগুলোর জীবনকাল প্রায় ৮ বছর হলেও আমাদের কাছে এমন ইঁদুরও আছে যেগুলো ১০ থেকে ১১ বছরের মতো বেঁচেছে।
বৃহৎ পাউচড ইঁদুরগুলো তাঞ্জানিয়ার স্থানীয়, এখানেই আমরা এদেরকে দিয়ে গত ২০ বছর ধরে ল্যান্ড মাইন খুঁজে বের করার কাজ পরিচালনা করে আসছি। আমাদের একটি চমৎকার প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে, আর আছে অসাধারণ কিছু প্রশিক্ষক যারা এখানকার অধিবাসী। আপোপোর লক্ষ্য মূলত মানবিক বিষয় নিয়ে কাজ করা। তাই আমাদের এই প্রজেক্ট স্থানীয়দের সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা পালন করবে।
প্রশ্ন: আপনারা ইঁদুরকে কীভাবে প্রশিক্ষণ দেন?
উত্তর: প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় প্রথমেই আমরা এদের শিখিয়েছি একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে শুরু করে আবার সেই স্থানেই কীভাবে ফেরত আসতে হবে। একজন প্রশিক্ষক ইদুরটিকে একটি ফাঁকা কক্ষে ছেড়ে দিয়ে ওই কক্ষে বিচরণ করতে দেন। একটা 'বিপ' বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে শুরুর স্থানে ফিরে আসতে হবে, তা ইঁদুরটিকে শেখানো হয়েছে। কাজটি সফলভাবে শেষ করতে পারলেই পুরস্কার হিসেবে তাদেরকে এভোকাডো ও কলামিশ্রিত গুঁড়ো খাবার দিতাম আমরা।
এরপর আমরা ইঁদুরগুলোকে তাদের ব্যাগে করে একটি করে রাবার বল টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ দিলাম। ব্যাগগুলো একটি ক্ষুদ্র সুইচের সাথে যুক্ত ছিল, যেটি থেকে 'বিপ' বাজত। এটি আসলে উদ্ধাকারীদের কাছে সংকেত পাঠাবে। এই কাজগুলো সাফল্যের সঙ্গে শেষ করার পর আমরা তাদের মানুষের সাথে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলাম। ইঁদুরগুলোকে মানুষের কাছে যাওয়া, বল টেনে আনা এবং 'বিপ' শোনামাত্রই শুরুর স্থানে ফিরে আসার টার্গেট দেওয়া হলো।
প্রশ্ন: আপনাদের সাফল্যের হার কেমন ছিল?
উত্তর: প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে আগস্টে, এখনো তা চলমান। প্রথমে 'বিপ' শোনার পরে নির্ভরযোগ্যভাবে ৩ সেকেন্ডের মধ্যে বেইজ পয়েন্টে ফিরে আসতে। এটি ছিলো প্রাথমিক পর্বে ইঁদুরগুলোর গড়ে ১৪টি সেশন লাগত। দ্বিতীয় পর্বে তাদের ১০টি সেশন লেগেছে ৩ সেকেন্ডের মধ্যে বল টেনে আনতে। তৃতীয় পর্বে আমাদের সবচেয়ে দক্ষ ইঁদুরগুলো তাদের কাজগুলো (ভিক্টিমের কাছে যাওয়া, বল টেনে আনা এবং শুরুর স্থানে ফিরে আসা) ৭টি সেশনের মধ্যেই শেষ করেছিল। এখন পর্যন্ত ৯টি ইঁদুর প্রাথমিক এবং দ্বিতীয় পর্বের প্রশিক্ষণে সম্পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেছে। ৬টি ইঁদুর পুরো বিষয়টা নির্ভরযোগ্যভাবে শেষ করার সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে।
প্রশ্ন: আপনারা তো শিশু এবং দুগ্ধপোষ্য ইঁদুরদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
উত্তর: ইঁদুরগুলোর বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যের পাশাপাশি এদের কর্মদক্ষতা এবং কর্মক্ষমতার মধ্যেও ভিন্নতা ছিল। দুটো ইঁদুর অন্য ইঁদুরদের মতো শুরুতে ভালো করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, কিছু ইঁদুর সরাসরি টার্গেটের কাছে যেত। তাদেরকে দেখে মনে হতো তারা সঠিক আচরণই করছে, কিন্তু তারা বল টেনে আনতো ন; ওরা শুধু যাত্রা শুরুর স্থানে ফিরে আসত।
কিন্তু প্রাণীদের সাথে আমার কাজ করার যে অভিজ্ঞতা সেখান থেকে বলতে পারি, এরা যেকোনো সময়েই আপনাকে চমকে দিতে পারে। তাই যে ইঁদুরগুলো এখন ভালো করছে না, হতেই পারে তারা হুট করে ভালো করবে এবং দেখা গেল তারাই ক্লাসে প্রথম হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে একটি ইঁদুর তার প্রশিক্ষকের থেকে কত দূরে যেতে পারে?
উত্তর: উদ্ধারকাজের সময় কুকুর ধ্বসংস্তূপ ভেদ করে ভেতরে যেতে পারে না। তারা মূলত ধ্বংসস্তূপের আশপাশে কিংবা বাইরে ঘ্রাণ শুঁকে বেড়ায়। তাই ইঁদুরগুলোকে ছাড়া হবে উদ্ধারকর্মীরা এবং কুকুরগুলো ধ্বংসস্তূপের স্থানে তাদের কাজ শেষ করার পর। ইঁদুরগুলোকে একাধিক প্রবেশপথ দিয়ে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে ঢোকানোর চিন্তা করেছি আমরা। আমাদের ধারণা অনুযায়ী, এরা গড়ে ১০ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত যেতে পারবে—সর্বোচ্চ ৩০ মিটার। তাই আমরা একটা বড় এলাকাজুড়ে উদ্ধারকাজ চালাতে পারব।
প্রশ্ন: এরকম দুর্যোগ-আক্রান্ত স্থানে ছুটে বেড়ানো ইঁদুর কারও ভয়ের কারণ হতে পারে?
উত্তর: কারও যদি ইঁদুরভীতি বা প্রাণীভীতি থাকে, সেক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু যেখানেই তাদেরকে উদ্ধারকাজের জন্য ব্যবহার করা হবে, সেখানেই আমরা প্রচারণা চালাব, যাতে মানুষজন জানতে পারে এমন কিছু ঘটতে পারে। ইঁদুরগুলোর পিঠে একটা ব্যাগ থাকবে। আর থাকবে মাইক্রোফোন, আলো ও ক্যামেরা। ব্যাকপ্যাক থেকে আওয়াজ বের হবে, যেটা হয়তো বলবে, 'আমি রেসকিউ-র্যাট, আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।'