এর সুগন্ধ নিন! ভারতের আতর শিল্পের উত্থান ঘটছে যেভাবে
গোপাল কুমার একটা ফুলের কন্দ তুলে নিয়ে পাপড়ির গোড়ার হালকা কালো অংশটুকু দেখিয়ে বললেন, ঠিক এই সময় গাঁদা ফুলের ঘ্রাণ সবচেয়ে সুন্দর। এরপর তিনি একটা গোলাপ শুঁকে বললেন, 'এই ঘ্রাণ আপনি কানৌজ ছাড়া আর কোথাও পাবেন না।'
কুমার গত ৫০ বছর ধরে কানৌজের বাইরে গঙ্গার ধারের উর্বর মাটির এক নিরিবিলি শহরে গোলাপের চাষ করছেন। তার জন্মানো ফুল ব্যবহৃত হয় আতর তৈরিতে।
উত্তর ভারতের কনৌজ সুপ্রাচীন পদ্ধতি 'ডেগ-ভাপকা' ব্যবহার করে আতর প্রস্তুতের জন্য প্রসিদ্ধ।
সুগন্ধি এবং আতরের এত দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও ১৯৮০ সালের শেষদিকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে পশ্চিমের সস্তা, অ্যালকোহল বেজের সুগন্ধির কাছে ভারতের আতর শিল্পের ধস নামে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কানৌজে ৭০০ ডিস্টিলারি থাকলেও ২০০০ সালের মাঝামাঝিতে তা ১৫০–২০০-তে নেমে আসে। কেউ কেউ দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে চন্দন কাঠের তেলের পরিবর্তে অ্যালকোহল বেজ ব্যবহার করাতে পণ্যের মান এবং বিশুদ্ধতা কমতে থাকে। উদারনীতির পরবর্তীসময়ে ভারতে তৈরি অধিকাংশ সুগন্ধি এবং এসেনশিয়াল ওয়েল বিদেশে রপ্তানি হতে থাকে যা পশ্চিমের সুগন্ধি এবং প্রসাধন শিল্পসহ তামাকজাত শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
সুগন্ধি শিল্পের নবজন্ম
২০২১ সালে মহামারির সময় দুই ভাই-বোন, ক্রাতী এবং বরুণ টেন্ডন কানৌজের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের কারিগরদের বাঁচাতে এবং এই শিল্প নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন 'বুন্দ ফ্র্যাগরেন্সেস'।
ক্রাতী বলেন, 'আমাদের বাবা একজন আতর ব্যবসায়ী ছিলেন। তাই আমাদের বেড়ে ওঠাও কানৌজের এই আতরকে ঘিরে। বছর গড়াতে বন্ধ হতে দেখেছি কত আতর কারখানা।
'আতর শিল্পের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এর বাজারজাতকণ। তবে তার থেকে বড় সমস্যা হলো মানুষের এই ব্যাপারে জ্ঞান। এই সুগন্ধি শিল্পের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেকেই জানেন না ।'
তবে ভারতে 'বুন্দ' এক বছরের মধ্যে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি অর্ডারের আতরের জোগান দিয়েছে। শীতে ভারতে বিয়ের মৌসুম আর ক্রিসমাসে স্থানীয়সহ দেশের বাইরে থেকেও অর্ডার আসে। কোভিডপরবর্তী সময়ে মানুষের এ বিষয়ে আগ্রহ বেড়েছে। তারা সিনথেটিক সুগন্ধি আর আসল আতরের মধ্যে পার্থক্য জানতে শুরু করেছেন।
সৌন্দর্য বিষয়ক লেখিকা অর্পণা গুপ্ত একে ভারতের ঐতিহ্যবাহী আতরের 'রেনেসাঁ' বলে অভিহিত করেছেন। এর জন্য তিনি বুন্দ-এর মতো ব্র্যান্ডগুলোকে কৃতিত্ব দিয়েছেন।
সুগন্ধি আতরের ঐতিহ্য
আতর প্রস্তুতের এ প্রক্রিয়া ঠিক কত প্রাচীন তা পরিষ্কার না হলেও তিন হাজার বছর পুরোনো ইন্দুস উপত্যকায় আতরের ডিস্টিলারি প্রক্রিয়ার নিদর্শন পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ১৬শ এবং ১৭শ শতকের সংস্কৃত লেখায় মোগল রানি নূরজাহানের আমলে আতর বা সুগন্ধি পাতন প্রক্রিয়ার উল্লেখ দেখা যায়।
এই আতরের উৎপাদন একেবারেই মৌসুমি। ফেব্রুয়ারির শীতে সূর্যের মৃদু উষ্ণতায় জন্মে কানৌজের 'দামাস্কা' গোলাপ। এই হালকা গোলাপি রংয়ের গোলাপ তুলে নিয়ে তাতে পানি ঢেলে রাখা হয় তামার তৈরি পাত্র ডেগে। ধাতব ঢাকনায় ঢেকে কাদামাটি দিয়ে পাত্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখান থেকেই বাঁশের পাইপের সাহায্যে গোলাপ আর পানির মিশ্রিত বাষ্প গিয়ে জমা হয় ছোট পাত্র ভাপকাতে। এভাবেই পাতনের মাধ্যমে প্রস্তুত হয় কনৌজের বিখ্যাত এই আতর।
'বুন্দ ফ্র্যাগরেন্সেস' মূলত স্থানীয় কারিগরদের সাহায্যে 'মিট্টি' ও 'খুশ' ব্যবহার করে ঐতিহ্যবাহী পুরোনো এবং নতুন সুগন্ধি প্রস্তুত করে যার ৬ মিলিলিটার বিক্রি হয় প্রায় ২০ ডলারে।
আতরে আধুনিকতা
"কাস্তুর'-এর প্রতিষ্ঠাতা এশা তিওয়ারি অবশ্য চান রাজা-বাদশাহদের ব্যবহৃত সেই পুরোনো ভারী আতর থেকে বেরিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন আতর তৈরি করতে। তিনি স্থানীয় আতর কারিগর আর নতুন সুগন্ধি বিশারদদের দিয়ে তৈরি করেছেন নতুন আতর যা বিক্রি হয় ২২ থেকে ৩৬ ডলার পর্যন্ত। এর মূল ক্রেতা মূলত মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষ যারা পুরোপুরি প্রাকৃতিক সুগন্ধি পছন্দ করেন ব্যবহারের জন্য।
কাস্তুর-এর দ্রুত উত্থান কনৌজ, হায়দ্রাবাদ এবং উত্তরাখণ্ডের প্রায় ১২ থেকে ১৫টি আতর কারিগর পরিবারের কর্মসংস্থান তৈরি করে করেছে। তার আগে এসব পরিবারের তরুণেরা আতর শিল্পের মন্দার কারণে এ শিল্প থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন।
মেইড ইন ইন্ডিয়া
নিজেদের বাজারের পাশাপাশি ভারতে আতরের এই নতুন ব্র্যান্ডগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ আতর রপ্তানি করছে। অ্যালকোহলমুক্ত হওয়ায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে সুগন্ধি এই আতর।
টেকসই অর্গানিক পণ্যের বাজার বৃদ্ধি আতরের নতুন বাজার সৃষ্টি করছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক সুগন্ধি শিল্পী ইয়শ হানের মতে 'সুগন্ধির ঔপনিবেশত্ত্ব থেকে মুক্তি' ভারতের আতরের বাজার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
কাস্তুর-নাম এসেছে 'কস্তুরী' থেকে, যা হরিণের নাভি থেকে পাওয়া একধরনের সুগন্ধি। লোকগাথা অনুযায়ী, এক হরিণ এই ঘ্রাণে বিমোহিত হয়ে এর উৎস খুঁজতে থাকে। অথচ এটি জানতই না ওই সুগন্ধে উৎস এটি নিজেই।
তিওয়ারি বলেন, 'আমরা এই রূপকই ব্যবহার করেছি আমাদের নামে। আমরা দেশে দেশে খুঁজে বেড়াচ্ছি সুগন্ধি, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ও মোহনীয় সুগন্ধি তৈরি হয় আমাদের দেশেই।'