লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা করে হুথিদের কী লাভ?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১০টি দেশের জোট এক হয়েও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের লোহিত সাগরে জাহাজ আক্রমণ বিরত রাখতে পারবে কি না এ নিয়ে এখনও সন্দেহ আছে। আপাতত দুই পক্ষই যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে চায়। আল জাজিরাকে এমনটাই জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
হুথি বিদ্রোহীদের মতে, শুধু ইসরায়েলের সাথে যোগাযোগ আছে এমন বাণিজ্যিক ও যুদ্ধজাহাজের ওপরই তারা হামলা করছে। মূলত গাজায় হামলা বন্ধে ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেই এই হামলা চালানো হচ্ছে বলে জানায় তারা। হুথিদের এই হামলা ইয়েমেনে আলোচনা তৈরি করেছে এবং অনেক নতুন যোদ্ধারাও এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন।
ইউরোশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক জর্জ ব্রু বলেন, 'গাজায় ইসরায়েলিদের অমানবিক অত্যাচার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হুথিরা এই হামলা থামাবে না। এমনকি তারা এর কিছুদিন পরও হয়তো হামলা চালিয়ে যাবে।'
৭ অক্টোবর থেকে চলা ইসরায়েলি সশস্ত্র হামলায় এখন পর্যন্ত ২০ হাজারেরও অধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: হুথিদের সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ
নভেম্বরের ১৯ তারিখের দিকে হুথিরা ইসরায়েলি সংযোগ থাকা কার্গো জাহাজ গ্যালাক্সি লিডারের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং তা দখল করার ভিডিও প্রকাশ করে। হুথি বিদ্রোহীরা পরবর্তীসময়ে বাব আল-মান্দেব প্রণালির মধ্য দিয়ে যাওয়া অসংখ্য জাহাজের ওপর আক্রমণ করেছে।
বাব আল-মান্দেব লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালের ভেতর দিয়ে যাওয়া একটি সংকীর্ণ পথ যার ভেতর দিয়ে সারা বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ কন্টেইনার জাহাজ যাতায়াত করে।
চাথাম হাউজ-এর মধ্যপ্রাচ্য উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের ডেপুটি হেড সানাম ভাকিল আল জাজিরাকে বলেন, 'উত্তর ইয়েমেনে হুথিদের অবস্থান তাদের ভু-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় ফেলে রেখেছে। গত কয়েকবছর ধরে আন্তর্জাতিক মহলে এটিকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল।'
হুথিদের হামলায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহনে ব্যাঘাত ঘটেছে। হামলার কারণে লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে কমপক্ষে ১২টি শিপিং কোম্পানি ট্রানজিট স্থগিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় ইতালিয়ান-সুইস কোম্পানি মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানি, ফ্রান্সের সিএমএ সিজিএম এবং ডেনমার্কের এপি মোলার-মার্স্ক।
বিশ্বের সমুদ্রবাহিত তেলের প্রায় ১২ শতাংশ এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের আট শতাংশ বাব আল-মান্দেব প্রণালি দিয়ে ইউরোপে যায়। তবে অন্যান্য পণ্য যেমন শস্য, পাম তেল এবং উৎপাদিত পণ্যগুলোও এসব আক্রমণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
অনেক কোম্পানি তাই আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত হয়ে জাহাজ পরিচালনা করছে যা তাদের যাত্রাসময় প্রায় নয় দিন এবং খরচ কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বাড়িয়েছে।
হামলায় প্রতিক্রিয়া
হামলার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হুথিদের কথিত ১৩ অর্থদাতার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে এবং তাদের হামলা প্রতিহত করতে ১০টি দেশ নিয়ে একটি সামুদ্রিক জোট গঠন করেছে।
জোটে যুক্ত হওয়া বাকি দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, সেশেলস এবং বাহরাইন।
এডেন থেকে পরিচালিত ইয়েমেন সরকার লোহিত সাগরের হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করেছেন। ইয়েমেনের গবেষক নিকোলাস ব্রুমফিল্ড আল জাজিরাকে জানান, 'এ সরকার একটি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। কারণ তারা চায় না তারা ইসরায়েলের সমর্থক হিসেবে প্রচার পাক।'
এদিকে হুথিদের প্রধান সমর্থক ইরান এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থেকেছে যা গাজার যুদ্ধকে বৃহত্তর অঞ্চলে বিস্তৃত করতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, হুথিদের ওপর ইরানের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ইতালিয়ান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল স্টাডিজ (আইএসপিআই)-এর সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট রিসার্চ ফেলো এলিওনোরা আরদেমাগনি আল জাজিরাকে বলেন, 'তেহরানের সাথে তাদের কিছু সম্মিলিত স্বার্থ আছে। তবে হুথিদের ওপর ইরানের প্রভাবকে অতিমূল্যায়ন করা উচিত নয়, তাদের নিজস্ব এজেন্ডা থাকতে পারে।''
ফিলিস্তিনি সমর্থন ও সংহতি
৭ অক্টোবরের আগে হুথিরা সরকার সংস্কার, বেতন পরিশোধে ব্যর্থতার মতো বিষয়গুলোর জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে ছিল। কিন্তু গাজার প্রতি তাদের এই সমর্থন তাদেরকে ইয়েমেনিদের মধ্যে আবারও জনপ্রিয় করে তুলেছে।
যদিও ইয়েমেন প্রায় দশ বছরের গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তবে ফিলিস্তিনের পক্ষে থেকে হুথিরা এতটাই সমর্থন পেয়েছে যে তারা নতুন করে যোদ্ধা তালিকাভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
ব্রুমফিল্ড বলেন, 'তারা ফিলিস্তিনের হয়ে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক সৈন্যকে তাদের দলে ভিড়িয়েছে। কিন্তু পরে তারা এসব সৈন্যকে ইয়েমেনি সরকারের শক্ত ঘাঁটি মারিবের বিরুদ্ধে মোতায়েন করে।'
কিছু বিশ্লেষকের মতে, লোহিত সাগরে হামলা একটি কূটনৈতিক কৌশলও হতে পারে। ২০২২ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতির জন্য হুথি এবং সৌদি আরব আলোচনা করেছে যা যুদ্ধ হ্রাস করেছে। সৌদি আরব ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে সমর্থন করে। লোহিত সাগরে উত্তেজনা এবং তেল বাণিজ্যে সম্ভাব্য বাধা বেশিরভাগ আঞ্চলিক অর্থনীতিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।
ভাকিল হুথিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেন, জাহাজে হামলা সৌদি আরবের ওপর চাপ বাড়ানোর একটি উপায় হতে পারে। এই পদক্ষেপকে তাদের সম্পর্কের পুনর্বিবেচনার একটি রূপ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
লোহিত সাগরে 'রেড লাইন'
বাব আল-মান্দেব এবং লোহিত সাগরের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিপিংয়ের ওপর প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মিত্রদের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। তবে এখন পর্যন্ত এটি হুথিদের প্রতিহত করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না।
গত সোমবার আল জাজিরাকে দেওয়া মন্তব্যে হুথির মুখপাত্র মোহাম্মদ আবদুল সালাম বলেন, 'আমরা প্রত্যেকের কাছে জোর দিয়ে বলেছি যে হুতির অভিযানগুলো গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থনের জন্য। আগ্রাসন ও অবরোধের মুখে আমরা নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। নৌঅভিযানের ক্ষেত্রে — তারা পুরোদমে কাজ করছে এবং সম্ভবত প্রতিটি অপারেশনের মাঝে ১২ ঘণ্টার বিরতিও থাকবে না।'
নানা বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও হুথি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই এখনও পর্যন্ত কিছুটা সংযম বজায় রেখেছে।
গত ২৬শে নভেম্বর হুথি দুটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে একটি একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজের কাছে অবতরণ করে। ব্রুমফিল্ড বিশ্বাস করেন, হুথিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যুদ্ধজাহাজটি থেকে দূরে মিসাইল ফেলেছে।
বর্তমানে মার্কিন জোট হুথি হামলাকে প্রতিহত করে লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে যাওয়া জাহাজগুলো রক্ষার জন্য বেশি আগ্রহী। ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক ব্রিউ বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংকট আর বাড়াতে চায় না।' হুথি সংগঠনটি লোহিত সাগরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত ইয়েমেনের দিকে পাল্টা গুলি চালায়নি।
সমীকরণের পরিবর্তন হুথির লক্ষ্য নয়। 'তারা জানে সীমা অতিক্রম করা যাবে না,' তিনি বলেন। হুথি এমন কোনো পরিস্থিতি চায় না যেখানে 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হুথিকে উত্তর ইয়েমেনের অপ্রীতিকর কিন্তু সহনীয় শাসক হিসেবে ভাবা বন্ধ করবে এবং সম্ভবত তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে'।