হুথিরা কারা? ইয়েমেনি এই গ্রুপকে জানতে সহজ গাইড
লোহিত সাগরে বিভিন্ন জাহাজকে লক্ষ্য করে কয়েক সপ্তাহ ধরেই ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে আসছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। জবাবে গত বৃহস্পতিবার হুথিদের অন্তত ৩০টি অবস্থানকে লক্ষ্য করে ইয়েমেনে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। হুথিরা এ হামলাকে 'বর্বরোচিত' বলে উল্লেখ করেছে।
হুথিরা ইরান সমর্থিত একটি গোষ্ঠী। গোষ্ঠীটি বলেছে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা ও এটি বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়ায় তারা লোহিত সাগরে হামলা চালিয়েছে।
হুথিরা প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলের সাথে সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে এ হামলা চালায়। এ হামলা থেকে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো রক্ষা করতে গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র একটি বহুপাক্ষিক জোট গঠন করে। পেন্টাগনের মতে, এ জোটে এখন ২০টিরও বেশি দেশ রয়েছে।
কারা এই হুথি?
হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী আনসার আল্লাহ (ঈশ্বরের সমর্থক) নামেও পরিচিত। এটি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। এরা ইয়েমেনের রাজধানী সানাসহ দেশটির বেশিরভাগ অংশ এবং সৌদি আরবের কাছাকাছি অবস্থিত পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
হুথিদের আবির্ভাব ১৯৯০ এর দশকে। কিন্তু ২০১৪ সালে ইয়েমেনের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে এ গোষ্ঠীর একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়।
এর পরে গোষ্ঠীটি ইরানের সমর্থনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোটের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে লড়াই চালায়। যদিও এই সময়ে উভয়পক্ষই শান্তি আলোচনার জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শিয়া দলটিকে ইরানের প্রতিরূপ হিসেবে দেখা উচিত নয়। এদের নিজস্ব ভিত্তি, স্বার্থ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের অবস্থা কী?
ইয়েমেনের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ করছে হুথিরা। এ কারণে দেশটিতে এক দশক ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। সৌদি আরবের সাথে গোষ্ঠীটির যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছে। দেশটির সরকার ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে এডেন শহর থেকে এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে রয়েছেন রাশাদ আল-আলিমি।
দেশটির নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আব্দে-রাব্বু মানসুর হাদির কাছ থেকে ২০২২ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন আল-আলিমি। হাদি এবং হুথিদের মধ্যে সম্পর্ক বিশেষভাবে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল।
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ দেশটিকে ব্যাপক সংকটজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। ২০২৩ সালের মার্চে জাতিসংঘ এ পরিস্থিতিকে 'বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকট' বলে উল্লেখ করে।
জাতিসংঘের মতে, ইয়েমেনের প্রায় ২১.৬ মিলিয়ন মানুষ বা দেশটির মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের 'খুব খারাপভাবে মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষা পরিষেবার প্রয়োজন'।
গত বছর হুথি ও সামরিক জোটের মধ্যে লড়াই অনেকাংশেই কমে যায়। ইয়েমেনি এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও সরকারি বাহিনী গত বছর তিন দিনে ৮০০ বন্দি বিনিময় করে।
হুথিরা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য ওমানের মধ্যস্থতায় সৌদি কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। সৌদি আরবও গত বছর ইরানের সাথে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করেছে, যা ইয়েমেনে শান্তি প্রক্রিয়ার আশা জাগিয়েছে।
হুথিরা কেন লোহিত সাগরের জাহাজে হামলা করছে?
হুথিরা বলছে, সম্ভাব্য ইসরায়েলের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজগুলো তারা লক্ষ্যবস্তু করছে। তাদের এ হামলার পেছনে মূলত কারণ হলো গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ শেষ করতে তেল আবিবকে চাপ দেওয়া। গত বছরের ১৮ নভেম্বর গোষ্ঠীটি গ্যালাক্সি লিডার নামে একটি কার্গো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ দখল করে। পরবর্তী সময়ে এটি তারা ইয়েমেনিদের জন্য একটি পর্যটক আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।
হুথির মুখপাত্র মোহাম্মদ আবদুলসালাম আল জাজিরাকে গত বছরের ডিসেম্বরে বলেছিলেন, 'আমরা প্রত্যেকের কাছে জোর দিয়েছি যে [হুথি] এসব অভিযান গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থন করার জন্য এবং আগ্রাসন ও অবরোধের মুখে আমরা নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না।'
হুথিরা এও বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের হামলার পরও তারা ইসরায়েলের সাথে সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে হামলা অব্যাহত রাখবে।
মোহাম্মদ আবদুলসালাম অনলাইনে লিখেছেন, 'তারা (যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য) যদি ভেবে থাকে যে তাদের হামলায় ইয়েমেন ফিলিস্তিন ও গাজাকে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকবে, তাহলে তাদের ধারণা ভুল।'
হুথিরা ইসরায়েলকে গাজায় মানবিক সহায়তা বাড়ানোর অনুমতি দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব হামলা অন্যান্য দিক থেকে হুথিদেরই উপকৃত করছে। কারণ, যখন এই গোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। ঠিক সেই সময়ে এসব হামলা এই গোষ্ঠীর সাথে অন্যান্য দেশ ও সরকারকে আলোচনায় বসতে এক প্রকার বাধ্য করবে।
বিশ্বের মোট বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খাল দিয়ে হয়ে থাকে। হুথিরা আক্রমণ শুরু করার পর থেকে বেশ কয়েকটি শিপিং কোম্পানি এই পথ দিয়ে তাদের জাহাজ না চালানোর কথা জানিয়েছে।