অ্যাপলের ৪০ বছরের পুরনো ম্যাকই বলে দেয় বাজারে এখনও আধিপত্য ধরে রাখার গোপন মন্ত্র!
আসছে ২৪ জানুয়ারি, ৪০ বছর পূরণ করতে যাচ্ছে অ্যাপলের 'ম্যাকিনটোশ' বা ম্যাক কম্পিউটার। এরই মাঝে বিগত বছরগুলোর তুলনায় ম্যাক কম্পিউটারের বিক্রি কমেছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। যা কি-না আগের বছরের ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিক্রির চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কম। তবে ম্যাক এখন আগের চেয়ে আরও বেশি পাতলা, দ্রুতগতির এবং বেশি সময় ধরে চার্জ ধারন করে রাখতে সক্ষম।
১৯৮৪ সালের ২৪ জানুয়ারি পথচলা শুরু হয় ম্যাক কম্পিউটারের। সহজে ব্যবহার করতে পারায় শুরুতেই মন জয় করে নেয় কম্পিউটারটি। এটিই মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেয় কম্পিউটারের ভবিষ্যতের সাথে। যার ডিজাইনই আজকের দিনের ডিভাইস ডিজাইনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সেই ঐতিহ্যই বহাল রেখেছে অ্যাপল। শুরুতে বাজারের খুব অল্প জায়গা দখল করলেও ব্যক্তিগত কম্পিউটার বিক্রি খাতে এখন এটি একটি টেকসই ব্যবস্থা। তাদের উদ্দেশ্য হলো ঘরে ঘরে, প্রতিটি কফির দোকানে, সব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শোভা পাবে অ্যাপলের লোগো সম্বলিত কম্পিউটার। কোম্পানিটি সেটি করতে সক্ষম হয়েছে।
অ্যাপলের ভাষ্যমতে তাদের 'বেস্ট সেলিং' ম্যাকবুক এয়ার, ২০১৯ সালের এক সার্ভে অনু্যায়ী দুই-তৃতীয়াংশ কলেজগামী শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ। দিন দিন আরও হালকা হচ্ছে ম্যাক কম্পিউটার। সেই সাথে ২২ ঘন্টার ব্যাটারি জীবন এই কম্পিউটারকে করে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য। ক্রোমবুক বা সারফেস এর কম্পিউটার আসলেও ম্যাকবুক প্রো, কম্পিউটার রাজ্যে ধরে রেখেছে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য।
অ্যাপল মার্কেটিংয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট গ্রেগ 'জজ' জোসিয়াক এক দুর্লভ সাক্ষাতকারে বলেন, "এটি কোনো স্মৃতিচারণের গল্প নয় বা পুরোনো কোনো ইতিহাসও নয়। এটা এমন এক অবিশ্বাস্য সত্য যা আমরা ৪০ বছর ধরে করে চলেছি।"
ম্যাকের বিবর্তনকে কয়েক ধাপে রাখা যায়। এর প্রথম সংস্করণে গ্রাফিক্স ইন্টারফেস ব্যবহারকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজাইন দেয়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ এবং কম্পিউটারের মধ্যকার সম্পর্কে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এরপর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সিইও স্টিভ জবস আই ম্যাকের ডিজাইনে আনে আমূল পরিবর্তন যা অ্যাপেলকে তার বর্তমান মহিমায় নিয়ে এসেছে।
২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে ডিজাইনের এই সূক্ষ্মতাই অ্যাপেলেকে এর বর্তমান ম্যাক ওএস এক্স এর সফটওয়ার ডেভেলপমেন্টের যুগে নিয়ে এসেছে। অ্যাপল আইফোনের মাধ্যমে মোবাইল জগতে প্রবেশ করে। ২০১০ সালে তারা জায়গা করে নেয় মোবাইলের এই দুনিয়ায়।
তবে ২০২০ সালের নতুন সংস্করণে সাধারণ অ্যাপল থেকে সিলিকন অ্যাপলে পরিবর্তন ম্যাক কম্পিউটার ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, বলছিলেন অ্যাপেলের হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট জন টারনাস। তার মতে, এটি ম্যাক কম্পিউটারের প্রাসঙ্গিক এবং প্রভাবশালী থাকার অন্যতম রহস্য।
২০০৭ সালে আইফোন যাত্রা শুরু করে খুবই দ্রুত সফলতা পায় বাজারে। কিন্তু এটি ম্যাক কম্পিউটারকে তার জায়গা থেকে না হটিয়ে বরং ম্যাক কে আরও শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। মোবাইল এবং ডেক্সটপের অ্যাপের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের ব্যবহারের জন্য আরো সহজ করার লক্ষ্যে অ্যাপল কাজ করছে বলে জানান অ্যাপলের হিউম্যান ইন্টারফেস ডিজাইনের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
অ্যাপলের প্রচলিত ধরণ থেকে সিলিকন চিপে পরিবর্তিত হওয়া ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে তারা তাদের আইফোনসহ ম্যাক কম্পিউটারের ব্যাটারি জীবন দীর্ঘ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে ব্যাটারি জীবন প্রায় ২২ ঘন্টা করতে পারা, এ যেন ফিজিক্সের সূত্রকেও হার মানায়।
প্রথমে অ্যাপল সিলিকনে পরিবর্তিত হলে তারা ম্যাকবুক এয়ারে কোন প্রকার ফ্যান সংযুক্ত ছাড়াই এর ব্যাটারি জীবন ১৮ ঘন্টা করতে সক্ষম হয়। ম্যাক এর কার্যক্ষমতা বাড়াতে কাজ চলছে। এক্ষেত্রে আইফোনের জনপ্রিয়তা তাদের বাজারে একটা বিশাল জায়গা করে দিয়েছে। এই সফলতাই অ্যাপলকে নিজেদের মন মতো কাজ করার সু্যোগ করে দিয়েছে।
ভবিষ্যতে আরো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে ম্যাক কম্পিউটারে, এমনটাই জানিয়েছেন অ্যাপেলের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের প্রধান মলি অ্যান্ডারসন। তিনি আরও বলেন, অ্যাপল শুধু জনপ্রিয়তার কথা না ভেবে সাথে কাজ বা কার্যকারিতার কথা ভেবে সবচেয়ে উন্নত ডিভাইস বানাতে চায় অ্যাপল।
অ্যাপলের 'স্পেশিয়াল কম্পিউটিং' কার্যক্রমের অংশ হিসেবে 'ভিশন প্রো' আসতে যাচ্ছে আগামী মাসে। 'ভিশন প্রো' হেডসেটের মাধ্যমে অ্যাপ চালানো থেকে শুরু করে ওয়েব ব্রাউজিং, ভার্চুয়্যাল কিবোর্ড ব্যবহার করা সহ ম্যাকের সবগুলো কাজ করা যাবে। এটি ম্যাকের সাথে ব্যবহার করা গেলেও প্রয়োজন হবে নতুন ধরণের অঙ্গভঙ্গি। যেকোন স্থানে কম্পিউটার ব্যবহার করার স্বাধীনতা দিবে ম্যাক। এমনকি প্রয়োজন পরবে না কোনো প্রকার হাতের স্পর্শের।
হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ডিজাইন, সাউন্ড ডিজাইন, ম্যাটেরিয়াল ডিজাইন, কালার ডিজাইনসহ একইসাথে প্রায় ৫০টি বিভাগের সব ডিজাইনার মিলে সকল ডিভাইসের মানোন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে অ্যাপল। এর মধ্যে রয়েছে 'হ্যাপটিক্স' বা যে প্রযুক্তির মাধ্যমে স্পর্শ এবং নড়াচড়ার মতো অনুভূতি উদ্দীপিত করা হয়। এগুলো ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা আরও সহজ করবে।
১৯৯৭ সালে স্টিভ জবস অ্যাপলে ফেরত আসলে তিনি ম্যাক কে সাধারণ ব্যবহারের জন্য 'কনজিউমার' এবং অভিজ্ঞদের ব্যবহারের জন্য 'প্রো' এই দুই বিশেষ ভাগে চারটি প্রধান মডেলের মধ্যে ভাগ করে দেয়। সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য ম্যাকবুক এয়ারের আইম্যাক, আইম্যাক মিনি এবং অভিজ্ঞদের জন্য ম্যাকবুক প্রো সিরিজের ম্যাক স্টুডিও ও ম্যাক প্রো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের বিবর্তনের যুগে অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যারা শুধুমাত্র সম্প্রতি এআই সংযুক্ত করেছে তাদের ডিভাইসের সাথে, সেখানে ২০২০ পরবর্তী অ্যাপেলের সব ডিভাইস এআই সম্বলিত।
কিন্তু অ্যাপেল কি আজ থেকে ৪০ বছর পরেও ম্যাক বাজারে নিয়ে আসতে পারবে?
জোসিয়াক এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, "ম্যাক ছাড়া অ্যাপেলকে ভাবাই যায় না। এটা আমাদের রক্তে মিশে আছে। এই পণ্যটি আমাদেরকে সংজ্ঞায়িত করে। প্রযুক্তির এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় স্টিভ জবস বোধহয় পরিচয় করিয়েছে অবিনশ্বর এক যন্ত্রের।"
তিনি আরও বলেন, "ম্যাক এই ইন্ডাস্ট্রির সকল উদ্ভাবন গ্রহণ করে ব্যবহার উপযোগী করেছে। প্রযুক্তির প্রতিটি বড় ধাক্কায়, গ্রফিকাল কম্পিউটিং থেকে ইন্টারনেট, এমনকি মোবাইলের যন্ত্রাংশ পর্যন্ত তৈরি করেছে অ্যাপল। এসবে নিজেদের সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ দেখিয়েছে তারা। স্পেশিয়াল কম্পিউটিং এবং এআইয়ের যুগে এসে ম্যাক তাদেরকে বারবার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে টিকে থাকবে আরো অনেক বছর। ধরে রাখবে তাদের জনপ্রিয়তা ও প্রয়োজনীয়তা।"