৬০ বছর আগে বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার এসেছিল যার হাত ধরে
ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় ফারাক ছিল বিস্তর। কিন্তু তারপরও অবহেলিত পূর্ব বাংলার মধ্যে থেকে উঠে আসেন এক উজ্জ্বল প্রতিভা—মুহাম্মদ হানিফউদ্দিন মিয়া।
সেসময় ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ অ্যাডাম কার্লের অনুমান অনুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তানে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ। আর পঞ্চম শ্রেণীতে উঠতে সক্ষম শিক্ষার্থীর হার ছিল মাত্র ২০ শতাংশ। এমন অবস্থায় ১৯৬৪ সালে এক বাঙালির মধ্যে কম্পিউটিং ও ট্যাবুলেটিং মেশিন পরিচালনার যোগ্যতা খুঁজে পাবে তা হয়ত কল্পনাতেই ছিল না পাকিস্তান সরকারের।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনস কর্পোরেশন (আইবিএম) পাকিস্তান সরকারের জন্য উপহার হিসেবে একটি ১৬২০ মডেলের মেইনফ্রেম কম্পিউটার পাঠায়। পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের (পিএইসি) লাহোর অফিসে এটি স্থাপন করা হবে।
কিন্তু পিএইসির এই মেইনফ্রেম কম্পিউটার চালানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে সেসময় কোনো কম্পিউটার অপারেটর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং পুরো পাকিস্তানে এটি চালানোর জন্য একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন ঢাকার হানিফউদ্দিন মিয়া।
তখন তরুণ হানিফউদ্দিন সোভিয়েত শাসিত চেকোস্লোভাকিয়া বিজ্ঞান একাডেমি থেকে অ্যানালগ কম্পিউটিং এবং ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। পিএইসি তাকে লাহোরে একটি আকর্ষণীয় চাকরির প্রস্তাব দিলেও তিনি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, 'নিজের দেশ ছেড়ে যাব না'।
এটি ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ কারণেই পিএইসিকে কম্পিউটারটি ঢাকায় পাঠাতে হয়।
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সাবেক সভাপতি ও সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের মতে, এটি বাংলাদেশে কম্পিউটারের প্রথম পদার্পণের সূচনা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) পাশে পিএইসির ঢাকার কার্যালয়ে (আণবিক কমিশন) আইবিএম ১৬২০ মডেলের মেইন ফ্রেম কম্পিউটারটি স্থাপন করে হানিফউদ্দিনকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এটিই ছিল দ্বিতীয় কম্পিউটার।
আইবিএমের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ১৬২০ মডেলের মেইনফ্রেম কম্পিউটারটি ছিল একটি জেনারেল পারপাস ডেটা প্রসেসিং সিস্টেম, যা প্রকৌশল, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানের জটিল সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ব্যবহৃত হতো। আইবিএম এই মডেলটি ২১ অক্টোবর, ১৯৫৯ সালে বাজারে আনে এবং ১৯ নভেম্বর, ১৯৭০ সালে এর উৎপাদন বন্ধ করে।
বাংলাদেশে স্থাপনের পর প্রথম দিকে এই ডেটা বিশ্লেষণ মেশিনটি মূলত ঢাকাভিত্তিক কিছু গবেষকই শুধু ব্যবহার করতেন। এদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এ এম এম আমানত উল্লাহ খানও ছিলেন।
১৯৭৩ সালে, অধ্যাপক খান ঢাকার কিছু স্থানের জমির দাম এবং শহরের কেন্দ্রস্থলের মধ্যে দূরত্বের সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য এই কম্পিউটার ব্যবহার করেন। তবে তার আসল উদ্দেশ্যই ছিল কম্পিউটারটি ব্যবহার করে দেখা, ডেটা বিশ্লেষণ নয়।
তিনি দেখেছিলেন, বিশাল একটি কামরাজুড়ে কম্পিউটারটি স্থাপন করা হয়েছিল। ঘরের এক কোনায় শুধু ডেটা ইনপুট ও আউটপুটের জন্য জায়গা খোলা রাখা হতো। প্রত্যেক ব্যবহারকারীর জন্য একটি পৃথক আইডি নম্বর নির্ধারিত ছিল, যা দিয়ে তারা মেশিনে প্রবেশ করতেন। মেশিনটি চালু হতে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় নিত।
অধ্যাপক খান স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'ইনপুট দেওয়ার জন্য আমরা সমস্ত তথ্য (মান) আইবিএমের পেপার টেপ পাঞ্চ কার্ডে লিখতাম। মেশিনের পরবর্তী অংশ ছিল একটি কার্ড রিডার, যা ডেটা বিশ্লেষণের জন্য প্রস্তুত করত। অ্যানালগ মেশিনটি চালাতে কয়েকজন অপারেটরের প্রয়োজন হতো। কিছু সময় পর, ব্যবহারকারীরা মেইলে প্রিন্ট করা আউটপুট পেতেন।'
অধ্যাপক খান আগে থেকেই তার ফলাফল অনুমান করতে পেরেছিলেন, তবুও আইবিএম ১৬২০ তাকে মেইলে নিশ্চিত করে বলেছিল— 'শহরের কেন্দ্র থেকে দূরত্ব এবং জমির দামের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে।'
আইবিএমের যুগ পেরিয়ে গেছে অনেক বছর, আমানত এখন বিভিন্ন আধুনিক ও উন্নত ডেটা বিশ্লেষণ সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। তবে বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটারের স্মৃতিস্বরূপ তিনি এখনও কিছু আইবিএম পাঞ্চ কার্ড সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
১৯৮০ সালের ৫ জুলাই আইবিএম ১৬২০ মডেলের কম্পিউটারটি সম্পূর্ণ অকেজো ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর এটিকে প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।
"বাংলাদেশে কম্পিউটারের প্রথম ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করলে সবার আগে হানিফউদ্দিনের নামই আসে," বলেন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং প্রথম বাংলা কী-বোর্ড বিজয় এর নির্মাতা মোস্তফা জব্বার।
১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর নাটোর জেলার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হানিফউ দ্দিন। তিনি ছিলেন এম রাজাবুল্লাহ তালুকদার ও নজিরন বিবির তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়। কৃষিনির্ভর এই পরিবারটি আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল। পিতার মৃত্যুর পর চৌগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থেকে গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন।
তিনি ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি সম্পন্ন করেন। দুই বছর পর, প্রথম শ্রেণিতে সম্মানসহ বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫২ সালে অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স-এ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএসসি সম্পন্ন করেন। এই অসাধারণ ফলাফলের জন্য তাকে একটি স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশনের (পিএইসি) ঢাকা অফিসে যোগদানের আগে হানিফুদ্দিন আট বছর ধরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গণিত পড়াতেন। ১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগ শহরে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি অ্যান্ড অটোমেশন-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) কম্পিউটার সেন্টারে সিস্টেম অ্যানালাইসিস, নিউমেরিক্যাল ম্যাথমেটিক্স, অ্যাডভান্সড কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং অপারেশন রিসার্চে আরও প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৭৫ সালে তিনি লন্ডনে আইবিএম রিসার্চ সেন্টারে অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করেন। এর আট বছর পর হানিফউদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন। সেখান থেকে কম্পিউটার সার্ভিস ডিভিশনের পরিচালক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
২০০৭ সালের ১১ মার্চ বাংলাদেশের কম্পিউটার যুগের অগ্রদূত হানিফউদ্দিন তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ফারিদা বেগম, পুত্র শরিফ হাসান এবং কন্যা নীতা শাহিন ও ডোরা শিরিনকে রেখে যান।
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও নিউমেরিক্যাল ম্যাথমেটিক্সে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও হানিফউদ্দিন ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যপ্রেমী। তিনি ইংরেজি, চেক, উর্দু, হিন্দি, আরবি, রুশ এবং জার্মান ভাষায় দক্ষ ছিলেন।
বাবার সাথে পুরোনো দিনের স্মৃতি এখনও মনে আছে ছেলে প্রকৌশলী শরীফের। তিনি জানান, তারা একসময় আজিমপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার বাবা ছিলেন লোকসংগীতের বিরাট ভক্ত, অবসর সময় কাটত তার গান, বই আর পড়াশোনায় মগ্ন হয়ে।
"যখনই রেডিওতে লোকসংগীত সম্প্রচারিত হতো, তার মুখে আনন্দের ছাপ দেখা যেত," বলেন তিনি।
অন্তর্মুখী ব্যক্তি হানিফ, অনেকটা সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন, গ্রামীণ সহজ-সরল জীবনের প্রতি একটা টান ছিল তার।
১৯৯৭ সালে তাকে প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের সামনে নিয়ে আসেন মোস্তফা জব্বার। তিনি বলেন, 'দুঃখজনক যে, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে খুব কম মানুষ জানে হানিফউদ্দিনের অবদানের কথা'।
তার ভাষ্যে, 'আমি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের বীর হিসেবে সম্মান করে। কিন্তু সব নায়করা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন না। কিছু নায়ক আছেন যারা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কিংবা তৎকালীন সুবিধা গ্রহণ না করে মাতৃভূমির উন্নতির জন্য সংগ্রাম করেছেন। হানিফউদ্দিন ছিল এমন একজন নায়ক'।
'হানিফউদ্দিনের জীবনী জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত", যোগ করেন তিনি।
২০১৫ সালের ১৭ জুন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি যৌথভাবে হানিফউদ্দিনকে বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপো ২০১৫-এ মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে। সাবেক আওয়ামী সরকারের পক্ষ থেকে তার নিজ গ্রাম হুলহুলিয়ায় একটি কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন