এআই ও টিকটককে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনি প্রচারণায় কারাবন্দি ইমরান খান!
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বর্তমানে বেশ কয়েকটি অভিযোগে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। এদিকে তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে তারা ভোটার ও কর্মীদের উৎসাহ দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও টিকটক ব্যবহার করছেন।
দলটি মূলত এআইয়ে সহায়তায় ইমরান খানের অবিকল কণ্ঠ তৈরি করে বক্তব্য প্রচার করছে। এক্ষেত্রে বক্তব্যের কন্টেন্ট আসছে খোদ দলনেতার কাছ থেকেই, আইনজীবীদের মাধ্যমে পাঠানো নোটের মাধ্যমে।
একইসাথে টিকটকে অনলাইন র্যালির আয়োজন করা হচ্ছে। পাশাপাশি ইমরান খানের ফেসবুক পেজে খোলা হয়েছে চ্যাটবট। যেখানে নির্বাচনে থাকা স্থানীয় প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য জানানো হচ্ছে। এছাড়াও সমর্থকেরা র্যালিতে 'প্রিজনার নম্বর ৮০৪' কোড ব্যবহার করছে; যা সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর জেল আইডি।
এআই দিয়ে তৈরি বক্তব্যে ইমরান খানকে বলতে শোনা যায়, "আপনারা যদি একযোগে বেরিয়ে আসেন তবে আমাদের হারানোর কোন উপায় নেই। কাউকে ভয় পাবেন না।"
৭১ বছর বয়সী সাবেক এই ক্রিকেটার গত মাসেই আদালত থেকে ১০ থেকে ১৪ বছরের সাজা পেয়েছেন।
এক্ষেত্রে পিটিআই মূলত এআই দিয়ে তৈরি বক্তব্যগুলোকে নির্বাচনি ক্যাম্পেইনে ব্যবহার করছে। দলটির ওপর নির্বিচারে নির্যাতন, গ্রেফতার ও মিডিয়া ব্ল্যাকআউটের পূর্বে অবশ্য তারা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দৌড়ে বেশ এগিয়েই ছিল।
ইমরান খানের সমর্থকদের দাবি, পারমাণবিক শক্তিশালী দেশটির গণতন্ত্র ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কেননা দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে আধিপত্য কায়েম করা রাখা রাজনৈতিক ও সামরিক সংস্থার বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হচ্ছে।
ইসলামাবাদ ভিত্তিক রিসার্চ গ্রুপ ভার্সো কনসালটিং এর পরিচালক আজিমা ছিমা বলেন, "ইমরানের কণ্ঠস্বর এবং ইমেজ পিটিআই-এর জন্য সবচেয়ে বড় সংগঠক হিসেবে কাজ করছে। তারা জনপরিসরে এটি ব্যবহার করতে সম্ভাব্য প্রতিটি টুল ব্যবহার করছে।"
আজিমা ছিমা আরও বলেন, "ইমরান এখনও অনেক বেশি জনপ্রিয়। তার কথায় বহু লোক ভোট দিতে প্রস্তুত।"
এদিকে ইমরান খান নিজের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই এসব করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে পিটিআইয়ের সিনিয়র সদস্য জুলফিকার বুখারি বলেন, "এসব পদক্ষেপ নির্বাচনের আগে জনগণের আশা ভঙ্গ করার জন্যই করা হয়েছিল। তবে এটি বরং আগামী ৮ ফেব্রুয়ারিতে লোকেদের বাইরে এসে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করবে। কারন যারা এখনো অন্তরালে আছেন তারা এসব কাজে বেশ বিরক্ত।"
এক্ষেত্রে পিটিআইকে লড়তে হচ্ছে আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সাথে। অভিযোগ রয়েছে যে, দীর্ঘদিন নির্বাসিত থাকা এই রাজনীতিবিদকে এবার দেশটির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করা সেনাবাহিনী পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছেন।
এদিকে পাকিস্তানের বর্তমান কেয়ারটেকার সরকারের তথ্যমন্ত্রী মুর্তজা সোলাঙ্গি পিটিআই-কে বাধা প্রদানের অভিযোগ অস্বীকার করেন। এটিকে তিনি 'প্রোপাগান্ডা' হিসেবে অভিহিত করেন।
ঐ মন্ত্রী বলেন, "এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। পুলিশ আইন অনুযায়ী কাজ করছে।"
১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের হয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ইমরান খান পিটিআই প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলটি সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও দেশটির সেনাবাহিনী পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে ২০২২ সালে সংসদে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে বাধ্য হন ইমরান খান। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রভাব ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর থেকে ইমরান খান ও পিটিআইয়ের ওপর খড়গ নেমে আসতে থাকে।
গত বছরের মাঝামাঝিতে পিটিআই সমর্থক ও নেতাদের গণগ্রেফতারের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। যাদের মধ্যে অনেকেই তখন চাপের মুখে দল ত্যাগ করে।
তারপর থেকে পিটিআইকে রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন করতে সরকারের পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকি গত সপ্তাহেও পুলিশ করাচিতে একটি নির্বাচনি সমাবেশে দলটির কয়েক ডজন সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন গত ডিসেম্বরে ব্যালট থেকে পিটিআই-এর নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট বাতিল করে দেয়। এতে করে দলটির প্রার্থীরা এবার নিজেদের প্রতীক ছাড়াই ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছে।
প্রথাগত প্রচারণা চালাতে না পেরে পিটিআই এবার তাদের নির্বাচনী প্রচারণার নতুনত্ব নিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে দলটির সোশ্যাল মিডিয়া স্ট্রাটেজি নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক জিবরান ইলিয়াস বলেন, "ইমরান খানকে ছাড়া আমরা কখনোই কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ করিনি। সেটা সরাসরি কিংবা ভার্চুয়াল যেখানেই হোক না কেন। এক্ষেত্রে সকল ধরনের উদ্ভাবনই জরুরি।"
পিটিআই এআই দিয়ে তৈরি ইমরান খানের প্রথম বক্তব্য প্রচার করে গত বছরের ডিসেম্বরে। সেক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টার্টআপ ইলেভেনল্যাবসের সহায়তায় অনুরূপ কণ্ঠ তৈরি করে। একইসাথে দলটি চলতি সপ্তাহে নিজেদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো অনলাইনে প্রকাশ করেছে।
পিটিআই সিনেটর জারকা সোহরওয়ার্দী তৈমুর বলেন, "আমাদের প্রচারণা এখন শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়াতে চলছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, সেখানে আমাদের বহু লোক অনুসরণ করছেন।"
তবে ইমরান খানের অনুপস্থিতে পিটিআই যে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় একাধিক প্রার্থী ইমরান খানের দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে দাবি করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে করে পিটিআইয়ের ভোট বিভক্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
৩০ বছর বয়সী রিকশাচালক শের খান নিজের রিকশার পেছনে ইমরান খানের পোস্টার লাগিয়ে ঘুরছেন। বেশিরভাগ লোক কোথায় ভোট দেবে সেটা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, "সরকার ইমরান খানকে নির্বাচনে বাধা দিতে চাইছে। কিন্তু রাজপথের পরিবেশ পিটিআইয়ের পক্ষে।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান