মাইক্রোওয়েভ প্লাস্টিক উপাদান আলুতে মিশিয়ে দেয়!
সুপারমার্কেটগুলো এখন 'রেডি টু ইট' শাকসবজি বিক্রি করছে। অর্থাৎ প্লাস্টিকের ব্যাগে থাকা সবজিগুলোকে মাইক্রোওয়েভ করার কয়েক মিনিটের মধ্যে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। আলু, বাঁধাকপি বা বিভিন্ন শাকসবজির মিশ্রণগুলোকে আগে থেকে রান্না করে রাখা হয় (প্রি-কুক)। এগুলোকে মাইক্রোওয়েভ করার জন্য অন্য পাত্রে রাখার প্রয়োজন নেই। সাথে থাকা প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতরেই গরম করা যায়।
তবে নতুন একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সবজিকে মাইক্রোওয়েভে গরম করার আগে প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে বের করে নেওয়া উত্তম।
ড. ফ্রান্সিসকো হোসে ডিয়াজ গ্যালিয়ানোর নেতৃত্বে আলমেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন যে, প্লাস্টিকের ব্যাগে শাকসবজিকে মাইক্রোওয়েভ করার ফলে শাকসবজিতে প্লাস্টিকের উপাদানগুলোর স্থানান্তর ঘটে। তারা এইভাবে প্লাস্টিকের ব্যাগে মাইক্রোওয়েভ করা আলুতে এইচএমপিপি-মাল্টোজ নামে একটি নতুন যৌগ খুঁজে পেয়েছেন। ডিয়াজ গ্যালিয়ানোর মতে, যৌগটি বিষাক্ত হতে পারে। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।
গবেষকরা বিভিন্ন ব্রান্ডের আলু দিয়ে কয়েক ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। আলুগুলোকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে রান্না করা হয়েছিল; আলাদা আলাদা প্লাস্টিক ও কাচের পাত্রে মাইক্রোওয়েভিং করে এবং আগুনের ওপরে পানিতে সিদ্ধ করে। ২৭ বার বিভিন্ন উপায়ে পরীক্ষার করার পরও সব আলুতে কম বেশি প্লাস্টিকের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা।
গবেষণার প্রধান গবেষক জানিয়েছেন, তারা তাদের পরীক্ষা থেকে দুই ধরনের ফলাফল পেয়েছেন। একটি প্রত্যাশিত এবং অন্যটি অপ্রত্যাশিত। প্রত্যাশিত ফলাফলটি হলো– মাইক্রোওয়েভে রান্না করার সময় প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে আলুতে পলিপ্রোপিলিন গ্লাইকল (পিপিজি) পলিমার স্থানান্তরিত হয়েছিল। এই স্থানান্তরটি কেবল মাইক্রোওয়েভে রান্নার সময় ঘটেছিল এবং অন্যান্য পদ্ধতির সময় নয়।
তিনি আরও জানান, মাইক্রোওয়েভ করার সময় আলুতে যে কেবল পিপিজি-ই স্থানান্তরিত হয় এমনটা নয়। রান্না করার সময় প্লাস্টিকের মধ্যে উপস্থিত থাকা অন্যান্য যৌগও খাবারে স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গবেষকরা কেবল রান্নার সময় খাবারে প্লাস্টিকের যৌগগুলোর স্থানান্তরিত হওয়ার প্রত্যাশিত ফলাফলই পাননি, তারা একটি অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারও করেছেন। পরীক্ষায় একটি নতুন যৌগ খুঁজে পেয়েছেন তারা, যার নাম এইচএমপিপি-মাল্টোজ। মূলত, প্লাস্টিকের (এইচএমপিপি) উপস্থিত একটি সিন্থেটিক ফটোইনিশিয়েটর এবং আলুর মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান মল্টোজের মধ্যে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফলে এই যৌগ গঠিত হয়। যেহেতু এই নবগঠিত যৌগটি আগে বর্ণনা করা হয়নি, তাই এর বিষাক্ততা বা সুরক্ষা সহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো এখনও নির্ধারণ করা হয়নি, এ নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন।
অ্যানালেটিক্যাল কেমিস্ট্রির একজন অধ্যাপক জানিয়েছেন যে, এইচএমপিপি (২-হাইড্রোক্সি -২ মিথাইলপ্রোপিওফেনোন) এবং এইচএমপিপি-মাল্টোজের সংমিশ্রণ উভয়ই বিষাক্ত হতে পারে । দলটি বর্তমানে এই যৌগটি কৃত্রিমভাবে তৈরির চেষ্টা করছে যাতে এর বিষাক্ততা সহ এর অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়।
খাদ্য সুরক্ষা বিধিমালার ক্ষেত্রে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১১ সাল থেকে খাদ্যে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বিষাক্ততা নিয়ন্ত্রণ করছে। খাদ্য সিমুল্যান্ট ব্যবহার করে পরীক্ষাগুলো করা হয়, যা খাদ্য এবং প্লাস্টিকের মোড়কের মধ্যে মিথস্ক্রিয়াকে নকল করে।
এই সিমুল্যান্টগুলোর মধ্যে এসিটিক অ্যাসিড, উদ্ভিজ্জ তেল এবং বিভিন্ন ইথানল-জল মিশ্রণের মতো তরল পদার্থের পাশাপাশি টেনাক্স টিএ নামে একটি শক্ত সিমুল্যান্ট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই পরীক্ষার সময় প্যাকেজিং থেকে খাবারে ক্ষতিকারক পদার্থ স্থানান্তরিত হয় কিনা তার ওপর ভিত্তি করে প্লাস্টিকের উপকরণগুলোর সুরক্ষা নির্ধারিত হয়।
ডিয়াজ গ্যালিয়ানো বিশ্বাস করেন যে, পূর্বোক্ত পদ্ধতিটি এখন আর পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়।
ডিয়াজ গ্যালিয়ানো এবং তার দল খাদ্য সিমুল্যান্ট এবং আসল আলু উভয়ই ব্যবহার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। পরীক্ষায় তারা দেখতে পান, খাবারের সিমুল্যান্টগুলো প্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসার সময় কোনো যৌগ স্থানান্তর করে না। কিন্তু আসল আলুর ক্ষেত্রে এরকম হয় না। আসল আলু প্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসলে, আলুতে প্লাস্টিকের যৌগ স্থানান্তরিত হয়। এই বৈষম্যটি পরামর্শ দেয় যে, খাদ্য সিমুল্যান্ট ব্যবহার করে বর্তমান পরীক্ষার পদ্ধতিটি বাস্তব-বিশ্বের পরিস্থিতি সঠিকভাবে প্রতিফলিত করতে পারে না।
মেডিকেল ডাক্তার এবং আলমেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক 'নিকোলাস ওলিয়া' জানান, খাবারে প্লাস্টিকের উপাদানের স্থানান্তর একটি উদ্বেগের বিষয়। ওলিয়া, খাদ্য এবং রান্নাঘরের পণ্যে ব্যবহৃত হতে পারে এরকম যে কোনো নতুন প্লাস্টিকের উপকরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
তিনি, বিদ্যমান প্লাস্টিক যৌগের পরীক্ষায় দুটি ত্রুটি উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, এ পরীক্ষায় বিভিন্ন রান্নার পদ্ধতি এবং সব ধরনের খাবারের ধরনের সমস্ত সম্ভাব্য সংমিশ্রণকে পরীক্ষা করা হয় না। দ্বিতীয়ত, পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে নতুন রাসায়নিক যৌগগুলোকে মূল্যায়ন করা হয়নি।
ডা. ওলিয়া খাদ্য প্রস্তুতির পদ্ধতিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং স্বচ্ছতার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ইউরোপীয় খাদ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ বা এফডিএর মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নির্দেশিকার জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে, খাবার বিক্রেতাদের রান্নার পদ্ধতির পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করা উচিত।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন