পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ
অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটে জর্জরিত পরিস্থিতির মধ্যেই দ্বিতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন শাহবাজ শরিফ।
সোমবার (৪ মার্চ) বিকালে দেশটির রাষ্ট্রপতির বাসভবনে এক অনুষ্ঠানে শাহবাজ শরিফকে শপথবাক্য পাঠ করান প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি।
৭২ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ এর আগে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
বিরোধীদের তুমুল বিরোধিতা সত্ত্বেও রবিবার নবনির্বাচিত পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন শাহবাজ। ৩৩৬ সদস্যের পার্লামেন্টে পিএমএল-এন ও পিপিপির জোটগত প্রার্থী শাহবাজ পেয়েছেন ২০১টি ভোট।
তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রার্থী ওমর আইয়ুব খান পেয়েছেন ৯২ ভোট।
তার সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাকিস্তানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।
অর্থনৈতিক সংকট
শাহবাজ শরীফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকার আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, ঋণের বোঝা, মানবসম্পদ উন্নয়নের বাধা এবং জ্বালানি ঘাটতিসহ অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশটির নাগরিকেরা মৌলিক খাদ্যপণ্য, বিদ্যুতের বিল ইত্যাদির মতো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর দামের উর্দ্ধগতিতে জর্জরিত।
এসব অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় রাজস্ব আয় শক্তিশালীকরণ, রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা জোরদার করা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে আগামী মাসে বর্তমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইএমএফের ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থ ছাড়ে একটি চুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা
ইমরান খান সমর্থিত প্রার্থীরা সাধারণ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য ভালো ফল করেছেন।
তারা অসংখ্য ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ৯৩ টি আসন পেয়েছেন। অন্যদিকে, ৭৯টি আসনে জয়ী হওয়া শাহবাজ শরিফের পিএমএল-এন ৫৪ টি আসন পাওয়া পিপিপি'রসঙ্গে জোট সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, শাহবাজ শরিফের প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থার অভাব রয়েছে। নিয়মিত রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেরূকরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগে ভঙ্গুর রাজনীতির প্রভাবে দেশের কার্যকর শাসনব্যবস্থা ও নীতিনির্ধারণ বাধাগ্রস্ত হয়।
এছাড়া, ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিশেষত সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের মতো প্রদেশগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্প এবং সুদৃঢ় জাতীয় নীতি বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, একটি তুমুল বিতর্কিত নির্বাচনের পরে বিরোধীরা তাকে খুব সহজেই শাসনকাজ পরিচালনা করতে দেবে বলে আশা করাও বোকামির নামান্তর।
ইতোমধ্যে পিটিআইয়ের প্রতি অনুরক্ত কিছু আইনপ্রণেতা স্পষ্ট করেই দিয়েছেন, তারা শাহবাজকে মোটেই চান না।
জঙ্গিবাদের উত্থান
শাহবাজ শরিফ প্রশাসনকেও দেশের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপারে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে।
ইসলামিক স্টেট এবং তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)- এর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো বিশেষত খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে বার বার হামলা করছে। সীমান্তে আফগানিস্তানের সঙ্গেও বেশ বৈরিতা রয়েছে দেশটির।
২০১৬ সালের পরের সাত বছরে পাকিস্তানে যতগুলো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে শুধু ২০২৩ সালেই।
দেশটিতে গত বছর বিভিন্ন হামলায় ৫৫০ জন নিরাপত্তা কর্মী ও ৪০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক প্রতিনিধি মালিহা লোধি বলেন, শাহবাজ শরিফের প্রশাসনকে 'ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড' এবং অন্যান্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করতে হবে।
এছাড়া, ঐতিহাসিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় জাতির মধ্যে কিছুটা ঐক্য ফিরিয়ে আনাও প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব।
নিঃসন্দেহে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন অপরিসীম সাহস ও বিশাল হৃদয়ের।
দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া শাহবাজ শরিফকে প্রমাণ করতে হবে, তার দ্বিতীয় মেয়াদ প্রথম মেয়াদের চেয়ে ভালো হবে।
এজন্য তাকে অবশ্যই উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে।
মন্ত্রণালয় ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোকে রাজনৈতিক আনুকূল্যের প্রতিদান হিসেবে তুলে ধরার সময় এটি নয়।
তার মনে রাখা উচিত, তার সরকারকে একটি কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। সামান্য নীতিগত বিভ্রান্তিও খুব দ্রুত একটি জাতীয় বিপর্যয়ের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। পিডিএমের সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয় এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তার আরেকটি প্রধান দায়িত্ব হবে পাকিস্তানের আশু রাজনৈতিক ভবিষ্যতের রূপরেখা এমনভাবে তৈরি করা, যাতে দেশটি ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ৩ মার্চের মধ্যকার সময়ের তিক্ততা ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
এর জন্য পিএমএল-এন এবং তার মিত্র দলগুলোকে প্রথমে ও সর্বাগ্রে পিটিআইকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর সব ধরনের পরিকল্পনা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
নতুন প্রধানমন্ত্রী যেহেতু দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাই এ বিষয়টিকে উপেক্ষা করা একটি মারাত্মক ভুল পদক্ষেপ হবে।
পরিশেষে বলা যায়, মি. শরীফ যদি তার শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখতে চান, তবে তাকে অসীম সাহস দেখাতে হবে।
সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি