টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে সিন্ধুর অন্ধ ডলফিন
নানাভাবে সংরক্ষণের প্রচেষ্টার পরও বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে সিন্ধু বা ইন্দুস নদীর অন্ধ ডলফিন। এই বিরল প্রজাতির মিঠাপানির ডলফিন শুধু পাকিস্তানেই দেখা যায়।
পয়ঃবর্জ্য, সার, কীটনাশক, শিল্প বর্জ্য ও ক্ষতিকর মাছ ধরার পদ্ধতির কারণে এই অনন্য জলজ প্রাণীটি মারাত্মক সংকটে পড়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অভ নেচার-এর (আইইউসিএন) লাল তালিকায় বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত এই ডলফিন নিয়ে গত কয়েক দশকে বিভিন্ন জরিপ পরিচালিত হয়েছে। ১৯৯২ সালে সিন্ধু নদীতে মাত্র ৫০০টি অন্ধ ডলফিন পাওয়া গিয়েছিল। তবে সংরক্ষণ প্রচেষ্টার ফলে ২০১৭ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজারে।
কিন্তু মানুষের কার্যকলাপ এবং আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে এই প্রাণীর টিকে থাকা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ।
ভারতের গঙ্গা নদীর ডলফিনের থেকে জাতভাই হলেও সিন্ধু ডলফিনের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে অনেক পার্থক্য আছে। নদীর কর্দমাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সিন্ধু ডলফিন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। কাদা ও ঘোলা জলের পরিবেশে বেঁচে থাকতে এই ডলফিন 'ইকোলোকেশন'-এর সাহায্যে চলাচল ও শিকার করে। উল্লেখ্য, শব্দ ব্যবহার করে প্রাণীর পথচলার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ইকোলোকেশন।
সিন্ধুর অন্ধ ডলফিনের লম্বা, করাতের মতো চোয়ালে ছোট ছোট দাঁত রয়েছে, যা শিকার ধরতে সাহায্য করে।
সিন্ধুর ডলফিনের নাক বেশ বৈশিষ্ট্যপূরণ্, দেখতে ভোঁতা তরবারির মতো। এ নাক ব্যবহার করে তারা নদীতে খাবার খোঁজে। এদের দৃষ্টিহীন চোখ অত্যন্ত ছোট, বড়সড় সূচের ফুটোর মতো। চোখে দেখতে না পেলেও সিন্ধুর ডলফিন আলোর পরিবর্তন টের পায়।
সিন্ধুর অন্ধ ডলফিন ও তাদের গঙ্গা নদীর জাতভাই প্রাচীন সিটেইশা অধিবর্গের একমাত্র টিকে থাকা উপপ্রজাতি। সিটেইশা অধিবর্গের প্রাণীরা ৫ কোটি বছর আগে প্রাচীন টেথিস সাগরে অবাধে চলাফেরা করত। অধুনালুপ্ত টেথিস সাগর একসময় বর্তমান ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
স্থলভাগের জায়গা বদল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমে যাওয়ায় মিঠাপানির সিন্ধু ডলফিন বর্তমানের পাকিস্তানের নদীগুলোতেই আটকা পড়ে।
১৯ শতকের শেষের দিকেও পাকিস্তানে সিন্ধু নদীর নিম্নাঞ্চল ও পাঞ্জাবে এর উপনদী ভারতের বিপাশায় ডলফিনের চলাচল ছিল।
১৮৭৮ ও ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ প্রাণিবিদ জন অ্যান্ডারসনের জরিপে দেখা গিয়েছিল, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে ১০ হাজার ডলফিন রয়েছে। ২০০১ সালে পকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের বন্যপ্রাণী বিভাগের এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, সিন্ধু নদীতে ৬১৭টি ডলফিন টিকে আছে। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ১ হাজারে দাঁড়ায়। ২০১৭ সালে আরেকটু বাড়ে এই সংখ্যা। তবে এখনও বিপদমুক্ত হয়নি প্রাণীটি।
সিন্ধু নদীতে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণের কারণে তাদের স্বাভাবিক চলাচল ও প্রজননের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।
মাছ ধরার জালও এই ডলফিনের জন্য বড় হুমকি। শিকারের সন্ধানে বের হওয়া অন্ধ ডলফিনগুলো প্রায়ই জালে আটকা পড়ে। এছাড়া মানুষের অসাবধানতায়—যেমন সেলফি তোলার চেষ্টায়—এই প্রাণীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।
স্থানীয় কিছু বিশ্বাসও সিন্ধুর অন্ধ ডলফিন সংরক্ষণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর তীরবর্তী কিছু গ্রামে ডলফিনটিকে প্রাচীনকালের মৎস্যকন্যা বলে মনে করা হয়, যে পরে মাছের রূপ নিয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) পাকিস্তান এই প্রজাতি রক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ডব্লিউডব্লিউএফ-এর ব্যবস্থাপক তাওহীদ ঘানি মেহসার জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন এবং 'পিংগার' প্রযুক্তি ব্যবহারের সুপারিশ করেন। এই ডিভাইসগুলো শব্দতরঙ্গ নির্গত করে ডলফিনদেরকে জাল থেকে দূরে রাখে। ফলে দুর্ঘটনাক্রমে ডলফিনের জালে আটকা পড়ার হার কমে।
২০২২ সালে তিনটি সিন্ধু ডলফিনের গায়ে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়, যা তাদের চলাচল ও আবাসস্থল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করছে।
গত দুই দশকে প্রায় ৩০০টি আটকা পড়া ডলফিন উদ্ধার করে নিরাপদে নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে।
বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত সংরক্ষণ প্রকল্প থাকলেও আরও নীতিমালা ও পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। ডব্লিউডব্লিউএফ-এর সমন্বয়ক ইমরান মালিক বলেন, কীটনাশক, শিল্প বর্জ্য ও অবৈধ জাল ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।