৩৫ পাউন্ডের ক্রিস্টাল পাথর, ৩০ হাজার পাউন্ডের হীরা; জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দাঁতের অলংকার!
চাকরির সাক্ষাৎকারের আগে ২৫ বছর বয়সী ক্যাম্পবেল প্রথমে কিছুটা ইতস্তত বোধ করছিলেন, তার নিয়োগকর্তারা তাকে দেখে কী বলবে এটা ভেবে। এ নিয়ে তিনি বলেন, 'আমি কিছুটা দ্বিধায় ছিলাম, কারণ আমি আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। কর্মক্ষেত্রে সাধারণত সবাই স্যুট-কোট কিংবা ফর্মাল জামা পরলেও আমি একটা ব্যাগি ট্রাউজার্স এবং একটি প্যাডেড জ্যাকেট পরে এসেছি।'
কিন্তু ক্যাম্পবেলের এ সংকোচ এখন অনেকটা কেটে গেছে। হয়েছেন আরও সাহসী। তিনি পূর্ব লন্ডনের একটি দাঁতের অলংকারের স্টুডিও আবিষ্কার করেছেন। সেখান থেকে নিজের দাঁতকে করেছেন গহনা দিয়ে অলংকৃত।'
তিনি বলেন, 'মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আরও সাহসী এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। সর্বোপরি, যদি লোকেরা গর্বের সাথে ট্যাটু প্রদর্শন করতে পারে তবে আমি কেন দাঁতের গহনা পরতে পারবো না?'
দন্তসজ্জা বা 'টুথ জুয়েলারি' এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দাঁতে এখন কেবল ছোট, সূক্ষ্ম রত্ন নয়, অপসারণযোগ্য ডিজাইন করা গ্রিলও ব্যবহার করা হচ্ছে যা সামনের দাঁতগুলোকে ঢেকে রাখে।
মূলত করোনা মহামারির কারণে যখন কর্মক্ষেত্রে ড্রেস কোডের ব্যাপারটা শিথিল হয়েছে, তখন থেকেই মানুষ এ ধরনের দন্তসজ্জায় আরও বেশি করে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মানুষ এখন তাদের হাসিকে নিজের মতো করে সাজাতে দাঁতে ব্যবহার করছে ক্রিস্টাল পাথর, হীরা, ওপাল এবং সোনা।
তাছাড়া অতীতের জেন্ডার স্টেরিওটাইপ ধারণাও ভেঙে যাচ্ছে। গহনা শুধু নারীরাই পরবেন এমন গৎবাঁধা বিশ্বাসেও আসছে পরিবর্তন।
২২ বছর বয়সী গ্রেসন ভট্টাল 'চান বিউটি'তে এসেছেন তার সামনের দাঁতগুলোতে রুপালি তারকা খোদাই করতে। এটাই তার প্রথম অভিজ্ঞতা।
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি আপনি এখন যা চান তা করার আরও স্বাধীনতা রয়েছে।'
এদিকে, চাই বিউটি টুথ-জেম টেকনিশিয়ান প্যাট্রিস নুয়েলি সম্প্রতি ৬০ বছর বয়সী একজন ক্লায়েন্টের দাঁতের উপর কাজ করেছেন। তাকে মারাত্মক স্টাইলিশ লাগছিল বলেও জানান তিনি।
নুয়েলির মতে, বর্তমানে দন্তসজ্জার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় হল 'কনফেটি' স্টাইল। কনফেটি পদ্ধতিতে দাঁত জুড়ে একাধিক রত্ন স্থাপন করা হয়। নুয়েলি জানান, তিনি এখন পর্যন্ত এক বসায় তার স্টুডিওতে ১০০টির মতো রত্ন পাথর লাগিয়েছেন।
এই রত্নগুলোতে প্রজাপতি, ফুল, চেরি, টিয়ারড্রপ এবং ইরিডেসেন্ট স্বরোভস্কি এবি ক্রিস্টালের মতো বিভিন্ন ডিজাইনের পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি পাথরের দাম ৩৫ পাউন্ড থেকে শুরু।
নিউক্যাসলের স্কালেন স্টুডিওর মালিক নিকোল গুটিরেজ-লক উল্লেখ করেন, জেনারেশন জেড বা জেনজি নামে পরিচিত তরুণ প্রজন্মরা ১৯০০ এর দশক এবং ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকের স্টাইল ও ট্রেন্ডে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। নিকোলের মতে তিনি নাকি নিজেও ১৯৬০ এবং ১৯৭০ দশকের ট্রেন্ডগুলো ১৯৯০ এর দশকে তার কৈশোর বয়সে অনুকরণ করেছিলেন।
নিকোল বিশ্বাস করেন যে ট্রেন্ড এভাবে সময়ের সাথে সাথে চক্রাকারে ফিরে আসে, একটি অবিচ্ছিন্ন লুপ গঠন করে। তার মতে দাঁতে রত্ন পাথর বা অলংকার ব্যবহারের মতো ব্যাপারগুলো শরীরের ট্যাটুর মতো জনপ্রিয় এবং ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। তিনি জানান, ২০২২ সালে তার স্টুডিওতে, দাঁতে রত্ন পাথর লাগানোর চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও মনে করেন এই প্রবণতাটি ইংল্যান্ডের উত্তরপূর্ব অঞ্চল থেকে দেশের অন্যান্য অংশেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
নুয়েলি ১ থেকে ৪ মিলিমিটারের চারটি স্বরোভস্কি ক্রিস্টাল দিয়ে ক্যাম্পবেলের দাঁতগুলো সাজিয়েছেন। প্রক্রিয়াটি ১৯৯০ এর দশকে ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর থেকে বেশ আলাদা। ওই সময় দাঁতে ড্রিল ব্যবহার করতে পেরেক ও আঠা ব্যবহার করা হতো। (তবে ঠিক কারা এরকম করতো, তার আসল পরিচয় এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি)
নুয়েলি দাঁতে একটি রুক্ষ পৃষ্ঠ তৈরি করতে প্রথমে এচিং অ্যাসিড প্রয়োগ করা শুরু করেন, তারপরে তিনি এক ধরনের রেজিন ব্যবহার করেন যা সাধারণত দাঁতের ব্রেইসের জন্য ডেন্টিস্টরা ব্যবহার করেন। তবে এখানে তিনি সাধারণ ব্রেইসের পরিবর্তে ক্রিস্টাল পাথর ব্যবহার করেন। এরপরে এক ধরনের বিশেষ আঠা প্রয়োগ করার পরে একটি আয়না দিয়ে ক্রিস্টলের অবস্থান পরীক্ষা করেন তিনি। আর সব শেষে আঠা শুকানোর জন্য একটি ইউভি আলো (অতিবেগুনি রশ্মি) ব্যবহার করেন।
পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যথাহীন এবং প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। ত্রিস্টালগুলো ক্যাম্পবেলের দাঁতে দুই বছর পর্যন্ত থাকতে পারবে। তবে তাকে দাঁত সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে, কোমল পানীয় পান করা বা জিহ্বা ব্যবহার করে ক্রিস্টালগুলোতে খুব বেশি নড়াচড়া করা যাবে না। ক্যাম্পবেল অবশ্য তার নতুন চেহারা নিয়ে খুশি, তার চুলের বিনুনি দুলছে এবং তার দাঁত ঝলমল করছে।
কসমেটিক ডেন্টিস্ট্রির উত্থানের পাশাপাশি দাঁতের গহনার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কসমেটিক ডেন্টাল পদ্ধতির বৃদ্ধি মহামারি চলাকালীন 'জুম বুম' এর জন্য দায়ী। এ সময় মানুষ তাদের চেহারা সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠে।
কোভিড পরবর্তী সময়ে দাঁত সোজা করা এবং ব্যহ্যাবরণের মতো পদ্ধতি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেক ব্রিটিশরা ইনভিসালাইনের মতো 'অদৃশ্য' ব্রেস বেছে নিচ্ছেন দাঁতে ব্যবহারের জন্য। গত বছর ব্রিটিশ অর্থোডন্টিক সোসাইটির এক জরিপে দেখা গেছে, তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থোডন্টিস্ট জানিয়েছেন, তাদের কাছে প্রাপ্তবয়স্কদের চিকিৎসা নিতে আসার চাহিদা বেড়েছে।
নুয়েলি জানান যে, তারা দাঁত সোজা করার জন্য জনপ্রিয় ইনভিসালাইন ব্রেসেও রত্ন সংযুক্ত করতে পারেন। তিনি বলেন, 'অনেক গ্রাহক আছেন যারা স্টুডিওতে সরাসরি না এসে আমাদের কাছে তাদের ব্রেস পাঠিয়ে দেন, আমরা রত্ন বা ক্রিস্টাল সংযুক্ত করে তাদের কাছে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিই।'
দাঁতের উপরে অনেকে কৃত্রিম ভিনিয়ারের আবরণ দিয়ে থাকেন। ভিনিয়ারের উপরে রত্ন লাগানোটা কঠিন বলে জানান নুয়েলি, কারণ এর পৃষ্ঠ অনেক মসৃণ থাকে যা পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্রিপ বা ঘর্ষণ সরবরাহ করে না।
কিছু স্টুডিও দাবি করে যে দাঁত এভাবে রত্ন ব্যবহার করা নিরাপদ, তবে অন্যরা এগুলোকে সৌন্দর্যের নামে অযথা উদ্যোগ হিসেবে দেখেন। অনেকেই আছেন দাঁতে এভাবে গহনা ব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন। দাঁতে এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং ফলক জমে যাওয়ার মতো সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেন তারা।
ব্রিটিশ ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ডা. প্রবীণ শর্মার মতে, রত্নগুলোর চারপাশে বা নিচে পরিষ্কার করা চ্যালেঞ্জিং। সময়ের সাথে সাথে, রত্ন এবং দাঁতের মধ্যে বন্ধন দুর্বল হতে পারে, যার ফলে এমন অঞ্চলে আরও ব্যাকটিরিয়া জমে যায় যা পরিষ্কার করা কঠিন। ব্যাকটিরিয়ার এই গঠনের ফলে অবশেষে দাঁত ক্ষয় এবং ক্ষতি হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ডেন্টাল নিয়ন্ত্রক জেনারেল ডেন্টাল কাউন্সিলের সাথে যোগাযোগ করলে তাদের একজন মুখপাত্র জানান যে, তারা দাঁতে গহনা প্রয়োগকে দন্ত চিকিৎসা হিসেবে বিবেচনা করেন। তাদের মতে, জিডিসিতে নিবন্ধিত না হয়ে যে কেউ এই পদ্ধতি সম্পাদন করলে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন বলে ধরা হবে।
তবে বাস্তবে এখনও এরকম কোনো মামলা হয়নি।
অন্যদিকে টেকনিশিয়ানরা যুক্তি দেন যে তারা ডেন্টিস্ট্রি-গ্রেড পণ্য ব্যবহার করেন, তাই ঝুঁকির পরিমাণ কম । স্টুডিও টেকনিশিয়ান এবং ডেন্টিস্ট উভয়ই অনলাইনে সহজেই পাওয়া যায় এমন ডিআইওয়াই হোম-অ্যাপ্লিকেশন কিটগুলোর বিপদ সম্পর্কে একমত হয়েছেন। এই কিটগুলো বিষাক্ততা, সংক্রমণ বা এমনকি দম বন্ধ হওয়ার মতো ঝুঁকি তৈরি করে।
তবে হ্যাটন গার্ডেনের মতো আভিজাত্য এলাকায় দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। বিলাসবহুল গ্রিল স্টুডিও প্লাইগ্রোন্ড এলডিএনকে থেকে ব্রিটিশ র্যাপার, অভিনেতা এবং গায়ক সহ বিভিন্ন তারকা, যেমন– রিতা ওরা, লেটিটিয়া রাইট, জেসি নেলসন, এবং জেমা কলিন্সরা তাদের দাঁতের জন্য কাস্টম গ্রিল তৈরি করেছেন।
প্লাইগার্ডের প্রতিষ্ঠাতা, সোলাঞ্জ গার্সিয়া এবং স্নো ভুওং জানান, দাঁতের গ্রিল যে কেবল পুরুষ হিপ-হপ তারকা এবং পুরুষ শিল্পীদের জন্য এই ধারণা পরিবর্তন করতে চান তারা । সৃজনশীল গ্রিল ডিজাইনের জন্য বাজারে একটি ভালো ব্যবসার জায়গা রয়েছে তা অনুভব করেন গার্সিয়া। এই ধারণা থেকেই তিনি এ ব্যবসায় আসেন। তার নিজের দাঁতেও অলংকার করা আছে। একটি দাঁতে শিখা নকশা এবং হীরা এবং অপর দাঁতে সোনার আবরণ রয়েছে।
তিনি জানান, মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম তার দাঁতে স্বর্ণ দিয়ে অলংকার করিয়েছিলেন।
গার্সিয়ার ক্লায়েন্টদের ষাট শতাংশই মহিলা। তিনি একটি নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করছেন তা হলো যারাই এভাবে দাঁতে ইচ্ছামতো গ্রিলদিয়ে সাজাচ্ছে, তারা মূলত এটিকে একটি বিলাসবহুল বিনিয়োগ হিসেবে দেখে।
২৫ বছর বয়সী পপ গায়িকা অ্যাভেরি ডনের নিচের দাঁতের গ্রিল হীরা, মুক্তা ও মুনস্টোন দিয়ে তৈরি, যার মূল্য ১৩০০ পাউন্ড। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, তার পছন্দের গ্রিলগুলো অত্যধিক চটকদার না হয়ে সূক্ষ্ম এবং মার্জিত দেখতে হতে হবে।
২৪ বছর বয়সী মেডিক্যাল ছাত্রী ক্লেয়ার ওয়াংয়ের নিচের দাঁতে রুপোর নকশা এবং উপরের দুটি দাঁতে সিলভার ক্যাপ রয়েছে। তিনি তাদের জন্য প্রায় ৪০০ ডলার খরচ করেছেন। দীর্ঘস্থায়ী এবং বাস্তব পণ্যগুলোতে আরও বিনিয়োগ করতে রাজি তিনি। ওয়াং মন্তব্য করেছেন, 'আমি আরও সচেতন ভোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছি।'
যখন কেউ কাস্টম গ্রিলের জন্য প্লাইগ্রান্ডের সাথে যোগাযোগ করে, তখন তাদের প্রথমে তাদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেবল রত্ন বা আকার পছন্দ করলেই হবে না। প্রতিষ্ঠাতাদের একজন স্নো ভুং ব্যাখ্যা করেন, গ্রিল করতে চাওয়া ব্যক্তি কোথায় বড় হয়েছেন, তাদের প্রিয় শৈশব স্মৃতি এবং তাদের প্রিয় রঙের মতো জিনিসগুলো সম্পর্কে তারা আগে অনুসন্ধান করে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন ক্লায়েন্ট যিনি সূর্যাস্ত এবং সমুদ্র পছন্দ করেন এবং তার জন্মভূমি তানজানিয়ায়। তাই তার জন্য শুধু তানজানিয়ায় পাওয়া যায় তাঞ্জানাইট পাথর ব্যবহার করে সমুদ্র এবং আকাশের নীল বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি গ্রিল তৈরি করে দেন তারা।
ভুওং জানান তিনি তার নিজের বাচ্চার দুধের দাঁতের জন্যও গ্রিল ডিজাইন করেছেন।
তবে দাঁতের অলংকার মোটেও সস্তা নয়। গার্সিয়ার তৈরি করা এখন পর্যন্ত সব থেকে দামি গ্রিলের মূল্য ৩০ হাজার ডলারেরও বেশি। এই গ্রিলে দাঁতের উভয় পাশেই হীরা লাগানো ছিল। ভুওং-এর মতে এটি একটি উপযুক্ত বিনিয়োগ।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন