যেভাবে ভারতের সবচেয়ে দামি স্টার্ট-আপ বাইজু’স এখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে
২০১৮ সালে বাইজু রবীন্দ্রনের শিক্ষা-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাইজু'স ভারতের সুপ্রতিষ্ঠিত স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ছিল। করোনাকালীন বৈশ্বিক মহামারির সময় স্কুল বন্ধ থাকার জন্য বাইজু'সের সাফল্য বাড়তে থাকে। কিন্তু এখন সব কিছুই বাইজু'সের জন্য সোনালি অতীত।
একসময় ভারতের নেতৃত্বস্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির মূল্য ছিল ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরকের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি বাইজু'সের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাইজু'সের মূল প্রতিষ্ঠান থিংক এন্ড লার্ন (টিএন্ডএল) এর বেশিরভাগ অংশীদার 'অব্যবস্থাপনা এবং ব্যর্থতার' অভিযোগ তুলে রবীন্দ্রনকে বিশেষ সাধারণ সভার (ইজিএম) মধ্য দিয়ে প্রধান নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
রবীন্দ্রন এবং তার পরিবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং ভোটের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা দাবি করেছেন, এই ভোট প্রতিষ্ঠানের আইন লঙ্ঘন করেছে কারণ ইজিএমে প্রতিষ্ঠানের আইন অনুযায়ী কমপক্ষে একজন প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক উপস্থিত থাকতে হবে। পরের দিন কর্মচারীদের কাছে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রন সভাটিকে 'প্রহসন' বলে অভিহিত করেছেন এবং এটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছেন।
কর্ণাটক হাইকোর্ট এই মামলার শুনানি চলাকালীন ইজিএমে পাস করা রেজ্যুলেশনগুলোর বাস্তবায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন।
চলতি বছরে এই আইনি জটিলতার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি অতীতে আরো বিভিন্ন আইনি জটিলতা ও আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
শুধু গত বছরেই বাইজু'স ক্রমবর্ধমান ঋণ, বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতাদের মামলা, ভারতের আর্থিক অপরাধ সংস্থার তদন্ত, হাজার হাজার কর্মচারীকে ছাঁটাই করা, দেরিতে কর্মচারীদের বেতন দেওয়া এবং তারল্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
এই বছরের জানুয়ারিতে বেশ কয়েকটি সময়সীমার পরে টিএন্ডএল ২০২২ সালে ৮২.৩ বিলিয়ন রুপি ক্ষতির কথা জানিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি এখনও ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে পারেনি এবং এটি গত বছরের ডিসেম্বরে নির্ধারণ করা সময়সীমার মধ্যে দাখিল করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাইজু'সের উপর গ্রাহকরা জোর করে বিক্রির অভিযোগও তুলেছেন যেখানে বলে হয়েছে, অভিভাবকদের তাদের সামর্থ্যহীন কোর্স কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ এনেছেন ভোক্তারা। কিন্তু ২০২১ সালে এই অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে খারিজ করে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
এই মাসে বাইজু'স কর্মচারীদের বেতন বিলম্বিত হওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছে যেহেতু মামলা চলাকালীন প্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যবহার করা সম্ভব না। এক মাস আগেই প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল, অর্থের অভাবে বেতন দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
২০১১ সালে একটি অনলাইন টিউটরিং ফার্ম হিসেবে বাইজু'সের যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ভারতে স্কুলছাত্রীদের ক্লাস এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় শেখার অ্যাপ চালু করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ভারতে আরো বেশী বিস্তার লাভ করে। বাইজু'সের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু সংক্রান্ত ট্যাবলেট, এসডি কার্ড এবং ল্যাপটপের মতো হার্ডওয়্যার বিক্রির মাধ্যমে।
২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে অনেক অর্থ খরচ করার পাশাপাশি আকাশ, টপপ্র, এপিক এবং গ্রেট লার্নিংয়ের মত শিক্ষা-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো অধিগ্রহণ করে বাইজু'স।
বাইজু'স এবং এর বিনিয়োগকারীদের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে কারণ প্রতিষ্ঠানটির নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবেলা করার জন্য বাইজু'স 'অধিকার ইস্যু' ব্যবহারের মাধ্যমে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করার একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিল। এই 'অধিকার ইস্যু' প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অংশীদারদের অতিরিক্ত নতুন শেয়ার কিনতে অনুমতি দেয়। এই পদক্ষেপটির জন্য বাইজু'স এবং এর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে।
ইজিএমের আগে রবীন্দ্রন বলেছিলেন, ইস্যুটি সম্পূর্ণরূপে সাবস্ক্রাইব করা হয়েছে এবং এই তহবিলগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হয় তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রতিষ্ঠান তৃতীয় পক্ষকে (সংস্থা) নিয়োগ করবে।
বাইজু'সের চারজন বিনিয়োগকারী ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইবুনালের (এনসিএলটি কর্পোরেট বিরোধের তত্ত্বাবধানকারী একটি আধা-বিচারিক কর্তৃপক্ষ) কাছে পিটিশন দাখিল করেছে এই 'অধিকার ইস্যু' স্থগিত করার জন্য।
বিনিয়োগকারীদের আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল বাইজু'সকে 'অধিকার ইস্যু' থেকে আয়কৃত অর্থ একটি আলাদা অ্যাকাউন্টে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। বাইজু'সের ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার আবেদনের শুনানি শুরু করার জন্য বিনিয়োগকারীরা উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন।
২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বাইজু'স স্পনসরশিপ দায়বদ্ধতা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় এবং ১.৫৮ বিলিয়ন রুপি বকেয়া পরিশোধ না করায় ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই) বাইজু'সের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল।
২২ ফেব্রুয়ারি ভারতের আর্থিক অপরাধ সংস্থা 'এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট' (ইডি) রবীন্দ্রনকে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নোটিশ জারি করেছে ৯৩ বিলিয়ন রুপি সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা সন্দেহজনকভাবে লেনদেনের জন্য।
বিবিসিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বাইজু'স জানিয়েছে, ইডির তদন্ত শেষ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, "বাইজু সমস্ত ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টগুলোর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য বজায় রেখেছে এবং বজায় রাখবে।"
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, রবীন্দ্রন বর্তমানে দুবাইতে আছেন এবং গত তিন বছর ধরে দিল্লি ও দুবাই যাতায়াত করছেন। বাইজু'স রবীন্দ্রনের অবস্থান সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেনি।
গত বছর বাইজু'সের বোর্ড সদস্যদের মধ্যে তিনজন: সিকোইয়া ক্যাপিটালের ভি রবিশঙ্কর, চ্যান জুকারবার্গ ইনিশিয়েটিভের ভিভিয়ান উ এবং প্রোসাসের রাসেল ড্রেসেনস্টক পদত্যাগ করেছেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এসওএস বিশ্ববিদ্যালয়) নৃতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় শ্রীবাস্তব লিখেছেন, বাইজু'স নিয়ে জনসাধারণের আলোচনা 'ভাল এবং খারাপ কর্পোরেট ব্যবস্থাপনার ভাষায় চলছে।'
শ্রীবাস্তব বাইজু'সকে 'শিক্ষার ফাস্ট-ফুড মডেল' হিসাবে বর্ণনা করেছেন যেটি "জনহিতকর কাজে এটির (বাইজু'স) প্রয়োজন আছে কি না সেটি প্রমাণ করা ছাড়াই মুনাফা উৎপাদনের যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।"
উচ্চ আদালতের শুনানির ফলাফল যাই আসুক না কেন বিশেষজ্ঞদের মতে, এর প্রভাব বেশী পড়বে রবীন্দ্রনের উপরেই।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়